Wednesday, 25 November 2020

কবিতা : দেখব এবার জগৎটাকে

দেখব এবার জগৎটাকে 

কাজী নজরুল ইসলাম 

থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে ; দেখব এবার জগৎটাকে ,

কেমন ক'রে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।  

দেশ হতে দেশ-দেশান্তরে , ছুটছে তারা কেমন ক'রে। 

কিসের নেশায় কেমন ক'রে মরছে যে  বীর লাখে লাখে , 

কিসের আশায় ক'রছে  তারা বরণ -মরণ যন্ত্রণাকে। 

কেমন ক'রে বীর ডুবুরি সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে , 

কেমন ক'রে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বর্গপানে।  

জাপটে  ধরে ,ঢেউয়ের ঝুঁটি যুদ্ধ - জাহাজ চলছে ছুটি '-

কেমন ক'রে আনছে মানিক বোঝাই ক'রে সিন্ধু-যানে ,

কেমন জোরে টানলে সাগর উথলে উঠে জোয়ার বানে।  

কেমন ক'রে মথলে পাথার লক্ষ্মী উঠেন পাতাল ফুঁড়ে ,

কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয়ের চূড়ে , 

তুহিন মেরু পার হয়ে যায় , সন্ধানীরা কিসের আশায় ? 

হাউই চ'ড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুরে -

শুনব আমি ইঙ্গিত কোন মঙ্গল হ'তে আসছে উড়ে।  

রইব নাকো বদ্ধ খাঁচায় , দেখব এবার ভুবন ঘুরে , 

আকাশ বাতাস , চন্দ্র তারায় সাগর -জলে পাহাড়-চূড়ে 

আমার সীমার বাঁধন টুটে , দশ দিকেতে প'ড়ব লুটে , 

পাতাল ফেঁড়ে নামব নীচে , উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে , 

বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।  


সার-সংক্ষেপ :  

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ' দেখব এবার জগৎটাকে ' কবিতায় এক কিশোরের সঙ্কল্পের কথা বলা হয়েছে।  সে বদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকবে না।  সে সারা পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে , আর কোথায় কী আছে সব জানার সঙ্কল্প করেছে।  সে বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযান করে সব কিছুকে হাতের মুঠোর মধ্যে আয়ত্ত করে নেবে।  সে দেখতে চায় মানুষ কিসের নেশায় দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে , আর লাখে লাখে বীর যুদ্ধে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। সে এও জানতে চায় কিসের আশায় তারা মরণের যন্ত্রণাকে বরণ করে নিচ্ছে।  সে জানতে চায় কেমন করে বীর ডুবুরি সমুদ্রের তলা থেকে মুক্তা তুলে আনে , কেমন করে দুঃসাহসী মানুষ রকেটে করে মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে।  যুদ্ধ জাহাজ কেমন করে সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝুঁটি ধরে সমুদ্রের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে আবার সেই জাহাজই সম্পদ বোঝাই করে নিয়ে আসছে।  কেমন করে জোয়ারের টানে সাগর উথলে উঠছে ও কেমন পাতাল ফুঁড়ে মানুষ লক্ষ্মী তুলে আনছে তাও ছেলেটি জানতে চায়।  ( ' পাতাল ফুঁড়ে লক্ষ্মীকে তুলে আনা ' অর্থাৎ তেলের খনি , কয়লার খনির কথা বোঝান হয়েছে।  ) মানুষ অভিযান করতে কখনোও হিমালয়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে , আবার কখনো তুষার মেরু পার হয়ে সন্ধানীরা ছুটে চলেছে আবিষ্কারের নেশায়।  সন্ধানীরা রকেটে চড়ে চাঁদে উড়ে যাচ্ছে আর মঙ্গলগ্রহ থেকে কীসের ইঙ্গিত উড়ে আসছে সেই সম্পর্কেও সে জানতে চায়।  সে একদম ঘরে বদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না।  সে সব রকম বাঁধন ভেঙে আকাশ , বাতাস , চাঁদ , তারা , সাগর -জলে ঘুরে বেড়াবে।  কিশোরটি তার সীমার বাঁধন ভেঙে দশ দিকে ( দশ দিক অর্থাৎ উত্তর , দক্ষিণ , পূর্ব , পশ্চিম , ঈশান , অগ্নি , বায়ু , নৈঋত , উর্দ্ধ , অধঃ ) ছড়িয়ে পড়বে।  কখনো পাতাল ভেদ করে নীচে নেমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে দেখবে আবার আকাশ থেকে মহাকাশে ছুটে চলবে।  বিশ্বজগতকে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলে সে অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাইছে।  


জেনে রাখো : 

লক্ষ্মী উঠেন পাতাল ফুঁড়ে : 

পুরাণে আছে যে , একবার দেবতা ও অসুরের মধ্যে বিবাদ বাধলে লক্ষ্মী ভয়ে পাতালে গিয়ে আশ্রয় নেন।  তখন দেবতা ও অসুররা সমুদ্র মন্থন করলে লক্ষ্মী বের হয়ে আসেন। 


কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয়ের চূড়ে : 

মানুষের জানার আগ্রহের শেষ নেই।  এই জানার আগ্রহেই তেনজিং আর এডমন্ড হিলারী এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হন।  


চন্দ্রলোকের অচিনপুরে : 

মানুষের অদম্য বাসনা মানুষকে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ঘুরিয়ে বেড়ায়।  এই অদম্য বাসনার জন্যই মানুষ বিজ্ঞান বলে মহাকাশকে জয় করে চাঁদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে।  চাঁদে প্রথম পা রাখেন নীল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিন।  এটি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ সে জুলাইয়ের ঘটনা।  

প্রশ্ন ও উত্তর 

(১) " দেখব এবার জগৎটাকে " কবিতায় কবি কী ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ? 

উত্তর :    "দেখব এবার জগৎটাকে " কবিতায় কবি পরিচিত জগতের বাইরে বেরোতে চেয়েছেন।  অচেনা -অজানাকে চেনা-জানার দুর্নিবার ইচ্ছার কথাই কবি এই এই কবিতায় প্রকাশ করেছেন।  

(২) কারা , কোথা থেকে মুক্তা আনে ? 

উত্তরঃ   ডুবুরিরা সাগর সেঁচে মুক্তা আনে।  

(৩) কারা এবং কেন মৃত্যুযন্ত্রণাকে বরণ করেন ? 

উত্তরঃ দেশের বীর জওয়ানরা মৃত্যুযন্ত্রণাকে বরণ করেন।  

      দেশের তথা দেশজননীকে সুরক্ষিত রাখতে বিদেশি আক্রমণ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে মরণ যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করেও তাঁরা নিজের জীবন বিসর্জন দেন।  

(৪) "চন্দ্রলোকের অচিনপুরে " বলতে কী বোঝ ? 

উত্তর :  চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ।   একসময় মানুষের কাছে পৃথিবীর এই উপগ্রহটি ছিল অজানা এক স্থান।  কিন্তু ওই চাঁদের সম্বন্ধে জানার কৌতূহল ছিল অদম্য।  তাই কবি এখানে চাঁদকে 'অচিনপুর' বলেছেন।  

(৫) কারা স্বর্গের দিকে উড়ে চলেছেন ? 

উত্তরঃ দুঃসাহসীরা স্বর্গের দিকে উড়ে চলেছেন।   

(৬) কবি  বিশ্বজগৎকে কী ভাবে দেখতে চান ? 

উত্তরঃ কবি বিশ্বজগৎকে হাতের মুঠোয় পুরে দেখতে চান।  

(৭) হাউই চড়ে কে কোথায় যেতে চায় ? 

উত্তরঃ হাউই চড়ে মহাকাশচারীদের মতো কবিও  চাঁদে ও মঙ্গলগ্রহে যেতে চায়।  









Saturday, 7 November 2020

সকল দেশের সেরা


 
সকল দেশের সেরা 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় 

ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা ,

তাহার মাঝে  আছে দেশ এক -সকল দেশের সেরা ;

ও সে , স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ , স্মৃতি দিয়ে ঘেরা ; 

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, 

সকল দেশের রানি সে যে - আমার জন্মভূমি।  


চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা , কোথায় উজল ধারা , 

কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে ? 

তার       পাখির ডাকে ঘুমিয়ে উঠি , পাখির ডাকে জেগে।  

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, 

সকল দেশের রানি সে যে - আমার জন্মভূমি।   


এত স্নিগ্ধ  নদী কাহার , কোথায় এমন ধুম্র পাহাড় ! 

কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশতলে মেশে ! 

এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে ! 

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, 

সকল দেশের রানি সে যে - আমার জন্মভূমি।  


পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী ; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখী ; 

গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে -

তারা ,  ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে ; 

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, 

সকল দেশের রানি সে যে - আমার জন্মভূমি।  


ভায়ের মায়ের এত স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ !

-- ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি , 

আমার এই দেশেতে জন্ম -- যেন এই দেশেতে মরি ---

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি, 

সকল দেশের রানি সে যে - আমার জন্মভূমি।  


কবিতার উৎস : কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় একাধারে তিনি ছিলেন নাট্যকার ও সঙ্গীতজ্ঞ।  তাঁর রচিত " সকল দেশের সেরা " কবিতাটি প্রকৃতপক্ষে একটি গান।  তাঁর " গান " কাব্যগ্রন্থ থেকে " সকল দেশের সেরা " সংকলিত হয়েছে।  


কবিতার  মূলভাব : 

ধনধান্য এবং পুষ্পে ভরা এই বসুন্ধরার মাঝে এক দেশ আছে।  এই দেশ কবির জন্মভূমি এবং সকল দেশের সেরা।  কবির এই স্বদেশ স্বপ্ন দিয়ে তৈরি এবং স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।  কবির কাছে এই দেশ সকল দেশের রানি।  এর চাঁদ , সূর্য , গ্রহ , তারা অতিশয় উজ্জ্বল।  এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও তুলনাহীন।  কবি এই দেশের ভৌগলিক অবস্থানকেও কবিতায় তুলে ধরেছেন।  এর নদী , পাহাড় , খেত -খামার , বৃক্ষলতা সবই মনোহর।  কবি এই দেশ মাতার চরণ দুখানি বক্ষে জড়িয়ে ধরে কৃতার্থ হন।  সমগ্র কবিতায় কবি তাঁর স্বদেশভূমির গৌরব কথাকে বাণীমূর্তি দান করেছেন। 

প্রশ্ন : 

(১) "তাহার মাঝে দেশ এক ----- সকল দেশের সেরা "

(ক) উল্লিখিত অংশটি কার লেখা ও কোন কবিতার অংশ ? 

(খ) কে , কাকে সকল দেশের সেরা বলেছেন ? 

(গ) কেন তাকে কবি সকল দেশের সেরা বলেছেন ? 

উত্তরঃ  

(ক) উল্লিখিত  অংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় " সকল দেশের সেরা " কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে।  

(খ) কবি তাঁর মাতৃভূমি ভারতবর্ষকে " সকল দেশের সেরা " বলেছেন।  

(গ) কবির চোখে তাঁর মাতৃভূমি ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ , সৌন্দর্যে , আন্তরিকতায় , মা- ভাইয়ের স্নেহে অনেক বেশি সম্পদশালী।  তাই কবি ভারতবর্ষকে " সকল দেশের সেরা " বলেছেন।  

(২) " এমন ধানের উপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে " 

(ক) এখানে কোন দেশের কথা বলা হয়েছে ? 

(খ) এই দেশের নদী , পাহাড় ,  ধানের ক্ষেত্রটি কেমন ? 

(গ )  কবি নিজের দেশকে কী নামে ডেকেছেন ? 

উত্তরঃ (ক)  " সকল দেশের সেরা " কবিতায় এখানে ভারতবর্ষের কথা বলা হয়েছে।  

(খ) এই দেশের পাহাড় ধুম্র অর্থাৎ ধোঁয়ার মতো রঙের ও নদীর রূপ  স্নিগ্ধ।  সবুজ ক্ষেত এত বিশাল যে মনে হয় আকাশে মিশে গেছে।  

(গ ) কবি নিজের দেশকে " সকল দেশের রানি বলে ডেকেছেন।  


(৩) " তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে " 

(ক) এখানে " তারা " বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে ? 

(খ) কবিতার এই অংশে কবি তাঁর জন্মভূমির যে দৃশ্যের কথা বর্ণনা করেছেন তা লেখ।  


উত্তরঃ  (ক) "সকল দেশের সেরা " কবিতায় এখানে "তারা " বলতে অলি অর্থাৎ ভ্রমরদের কথা বলা হয়েছে।  

(খ) কবি কবিতায় বলেছেন তাঁর জন্মভূমি ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি বৃক্ষ ফুলে ফুলে ভরে থাকে আর সেই ফুলের বাগানে পাখী গান গেয়ে বেড়ায়।  ভ্রমররা গুনগুন করে দলে দলে ধেয়ে আসে সেই ফুলের মধু খাওয়ার জন্য আর ফুলের মধু খেয়ে তারা সেই ফুলের উপরই ঘুমিয়ে পড়ে।  


(৪)"  ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি " 

(ক)  কবিতাটিতে কাকে 'মা' বলা হয়েছে ? 

(খ) সেই মায়ের কাছে কবি কী প্রার্থনা করেছেন ? 

(গ) কেন তিনি এমন প্রার্থনা করেছেন ? 

উত্তরঃ  

(ক) " সকল দেশের সেরা " কবিতায় কবি তাঁর " মাতৃভূমি " ভারতবর্ষকে " মা " বলেছেন।  

(খ) কবি তাঁর মাতৃভূমিরূপ "মা" এর পা দুটি বুকে ধরে  প্রার্থনা করেছেন যে তাঁর এই দেশেতেই যেমন জন্ম হয়েছে তেমন তাঁর যেন এই দেশেতেই মৃত্যু হয়। 

(গ) কবির মতে তাঁর মাতৃভূমি ভারতবর্ষের মত মা-ভাইয়ের স্নেহ অন্য কোন দেশে পাওয়া যায় না।  এই দেশে জন্মগ্রহণ করে তিনি নিজেকে ধন্য মনে করছেন।  এই দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অন্য সব দেশের থেকে বেশি।  তাই তিনি এই দেশেতেই যেমন জন্মগ্রহণ করেছেন তেমন তিনি এই দেশেই মৃত্যুবরণ করতে চান।   

(৫) " স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ , স্মৃতি দিয়ে ঘেরা " 

(ক) আলোচ্য অংশটি কার লেখা ? কোন কবিতার অংশ ? 

(খ) কে কোন দেশকে " স্বপ্ন দিয়ে তৈরি " দেশ বলেছেন ? 

(গ) কেন কবি একথা বলেছেন ? 

উত্তর : 

(ক)  আলোচ্য অংশটি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা 'সকল দেশের সেরা ' কবিতার অংশ।  

(খ) কবি তাঁর মাতৃভূমি / জন্মভূমি ভারতবর্ষকে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি দেশ বলেছেন।  

(গ) এই পূণ্যভূমি  ভারতবর্ষে কত শত মহাপুরুষের জন্ম হয়েছে।  এই দেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলার স্বপ্ন তাঁরা দেখেছেন।  তাঁদের সেই স্বপ্ন ও জীবনস্মৃতিতে ঘেরা আছে কবির জন্মভূমি ভারতবর্ষ।  

(৬) " কোথায় এমন হরিৎ ক্ষেত্র আকাশতলে মেশে " 

(ক) কবি এই কবিতায় কোন দেশের কথা বলতে চেয়েছেন ? 

(খ) কবি এই দেশকে কী কী নাম ডেকেছেন ? 

(গ) 'হরিৎক্ষেত্র ' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ? 

উত্তরঃ 

(ক) কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় 'সকল দেশের সেরা ' কবিতায় তাঁর জন্মভূমি ভারতবর্ষের কথা বলতে চেয়েছেন।  

(খ) কবি এই দেশকে তাঁর জন্মভূমি ও 'সকল দেশের রানি ' বলে ডেকেছেন। 

(গ) 'হরিৎক্ষেত্র ' বলতে সবুজ রঙের ক্ষেত বুঝিয়েছেন।  

(৭) " সকল দেশের রানি সে যে " 

(ক) কবি কাকে সকল দেশের রানি বলেছেন ? 

(খ) কেন বলেছেন ? 


উত্তরঃ 

(ক) 'সকল দেশের সেরা ' কবিতায় কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর জন্মভূমি ভারতবর্ষকে 'সকল দেশের রানি ' বলেছেন।  

(খ) রূপে গুণে সেরা রমণীকেই রানি বলে অভিহিত করা হয়।  কবির চোখে তাঁর জন্মভূমি ভারতবর্ষ পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের তুলনায় প্রাকৃতিক সম্পদ , সৌন্দর্যে , আন্তরিকতায় , মা-ভাইয়ের স্নেহে অনেক বেশি সম্পদশালী।  তাই কবি ভারতবর্ষকে 'সকল দেশের রানি ' বলে অভিহিত করেছেন।  










 


Friday, 6 November 2020

আবার আসিব ফিরে







  আবার আসিব ফিরে 

জীবনানন্দ দাশ 

আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে - এই বাংলায় 

হয়তো মানুষ নয় - হয়তো -বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে , 

হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে -

কুয়াশার  বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় ; 

হয়তো বা হাঁস হব - কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায় ,

সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে ; 

আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ  ক্ষেত্রে ভালোবেসে 

জলাঙ্গি  ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়। 

হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন  উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে ;

হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে ; 

হয়তো খইয়ের ধান ছড়াইতেছে শিশু এক উঠোনের ঘাসে 

রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদাছেঁড়া -পালে 

ডিঙা বায় , রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকার আসিতেছে নীড়ে ,

দেখিবে ধবল বক : আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।   


 বিষয় সংক্ষেপ : 

রবীন্দ্রোত্তর কাব্যধারার অন্যতম পথপ্রদর্শক জীবনানন্দ দাশ(১৮৯৯-১৯৫৪)।  রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে বলেছেন 'চিত্ররূপময়'।  " আবার আসিব ফিরে " কবিতা টি একটি সনেট  জাতীয় কবিতা।  এটি "রূপসী বাংলা " কাব্য গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।

           'আবার আসিব ফিরে ' কবিতাটিতে কবির প্রকৃতি প্রেম , গ্রামবাংলার প্রতি কবির  ভালোবাসা ও গভীর আকর্ষণ প্রকাশ পেয়েছে।  

              গ্রাম বাংলার প্রকৃতি , ইতিহাস ও সৌন্দর্য জীবনানন্দের  কবিমানসের যে  অনুভূতির  সঞ্চার করেছে।  তারই কাব্যিক রূপায়ণ হল এই কবিতা।  পল্লিবাংলার পরিবেশ এবং তার সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এখানে। বাংলার  পল্লি -প্রকৃতিকে তিনি এত ভালোবেসেছিলেন যে, মৃত্যুর পরও যদি কোনো জন্মান্তর থাকে তবে কবির এই  আকাঙ্ক্ষা   কবিতাকে  এক অন্য মাত্রা দিয়েছে।  কবি বলেছেন , তিনি পুনরায় এই পল্লি বাংলার ধানসিড়ি নদীর তীরে জন্ম নিতে চান।  মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করতে না পারলেও কবির কোনো দুঃখ থাকবে না। শঙ্খচিল কিংবা শালিখ অথবা ভোরের কাক  হয়ে কার্তিক মাসের সকালে কুয়াশা ভেজা নবান্নের দেশে কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা শান্ত বাংলায় ভেসে বেড়াতে চান কবি। হয়তো হাঁস হয়ে তিনি বিচরণ করবেন কলমীর গন্ধভরা পুকুরের শান্ত নিস্তরঙ্গ জলে , গ্রাম্য কিশোরীর পায়ের ঘুঙুরের মতো কলমীর লতা জড়ানো থাকবে তার লাল পায়ে।   বাংলার নদী , মাঠ , ক্ষেত কবির ভালোবাসার  স্থান।  তিনি আবার এখানে ফিরে আসতে চান জলঙ্গি নদীর ঢেউয়ে ভেসে সবুজ প্রকৃতির কোলে।  

             বাংলার আকাশে উড্ডীন সুদর্শন পাখির মতো সন্ধ্যার বাতাসে মিশে থাকতে পারেন কবি।  হয়তো শিমুল গাছের ডালে বসে ডাকছে যে লক্ষ্মীপেঁচা তার অস্তিত্বের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে কবিকে।  উঠানের  ঘাসে খই ছড়াচ্ছে যে শিশু বা রূপসা নদীর ঘোলাজলে সাদা পাল ছেঁড়া ডিঙা ভাসাচ্ছে যে কিশোর তার মধ্য দিয়েই কবি ফিরবেন পল্লি বাংলায়। কবি বলেছেন যে , সাদা বকেরা রাঙা মেঘের মধ্য দিয়ে সাঁতার দিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে পড়ন্ত সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফেরে তাদেরই ভিড়ে মিশে থাকবেন কবি হয়তো তাদেরই একজন হয়ে।  এই ভাবেই প্রকৃতির গভীরতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মৃত্যুর পর পুনরায় এ বাংলার পল্লীজীবনে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন কবি নানা রূপে , নানা ভাবে।  


 প্রশ্নোত্তর : 

(১) " আবার আসিব ফিরে " কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে ? 

উত্তর : " রূপসী বাংলা " কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।  


(২) " আবার আসিব ফিরে " কী জাতীয় কবিতা ? 

উত্তর :  সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা। 


(৩) কবি কোথায় ফিরে আসতে চান ? 

উত্তর : কবি এই বাংলায় ধানসিড়িটির তীরে ফিরে আসতে চান। 


(৪) তিনি কোন কোন রূপে ফিরে আসতে চেয়েছেন ? 

উত্তরঃ কবি আগামী জন্মে শালিখ , শঙ্খচিল , হাঁস ইত্যাদি রূপে ফিরে আসতে চেয়েছেন।  


(৫) কবির ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা কেন ? 

উত্তরঃ  বাংলার মাটির সঙ্গে কবির চেতনা এমন গভীর ভাবে অন্বিত যে মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা থেকে বিচ্ছেদ তিনি সহ্য করতে পারে না।  তাই তাঁর অন্তরে সুতীব্র বাসনা জাগ্রত হয়েছে। 


(৬) " সবুজ করুণ ডাঙায় " কথাটির অর্থ কী ? 

উত্তরঃ কবি বাংলার শ্যামলভূমিকে সবুজ ডাঙা বলেছে।  " করুণ " বলার মধ্যে নিহিত আছে এই ভূমি থেকে বিচ্ছেদজনিত বেদনার অনুভূতি।  

(৭) "সুদর্শন " কথাটির অর্থ কী ? কোন প্রসঙ্গে  এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ? 

উত্তরঃ  " সুদর্শন " কথাটির অর্থ চিল।  

              বাংলার  সন্ধ্যার আকাশে চিলের চক্রাকারে আকাশ পরিভ্রমণ অতি স্বাভাবিক দৃশ্য।  এই প্রসঙ্গে " সুদর্শন " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।  


(৮) " খইয়ের ধান " কথাটির অর্থ লেখ।  

উত্তরঃ  খই ভাজার পর ধানের বহিরাবরণ ছড়িয়ে রাখা হয়।  শিশুরা সেগুলি নিয়ে খেলা করে।  সেই চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য " খইয়ের ধান " বলা হয়েছে।  


(৯)  " আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে " 

----   কাকে কাদের ভিড়ে পাওয়া যাবে বলা হয়েছে ? 

উত্তর : কবি বাংলার দৃশ্য সম্পদকে এমনই ভালবাসেন যে , মৃত্যুর পর নিজেকে সেই  সব দৃশ্যের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে অন্বিত( যুক্ত )  হতে চেয়েছেন।  সন্ধ্যার আকাশের চিল, শিমূলের ডালে বসা  লক্ষ্মীপেঁচা , উঠোনের ঘাসে খই -এর ধান ছড়ানো শিশু , সাদা ছেঁড়া পলে ডিঙা বেয়ে চলা কিশোর , অন্ধকারে ঘরে ফেরা ধবল বক ইত্যাদির মধ্যে কবি নিজের অস্তিত্ব অন্বিত করে বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন।  

(১০) " আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয়    ................." 

(ক) কবির এইরূপ ইচ্ছার কারণ কী ? 

(খ) কবি কীসে বিশ্বাসী ? 

(গ) তিনি কীভাবে এই বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন ? 

উত্তরঃ 

(ক) কবির এই রূপ ইচ্ছার কারণ বাংলার প্রতি তাঁর  গভীর  ভালোবাসা।  কবি বাংলার নদী , মাঠ , ঘাটকে ভালোবেসে ফিরে আসতে চান এই বাংলায়।  

(খ) কবি জন্মান্তরে বিশ্বাসী।  তাঁর বিশ্বাস  এ জন্মে নয় পরের 

জন্মেও কবি এই বাংলায় ফিরে আসবেন।  মানুষ হয়ে না এলেও হয়তো অন্য কোনো প্রাণী যেমন -শঙ্খচিল , শালিখ, কাক , হাঁস অথবা অন্য কিছুর রূপ নিয়ে এই বাংলাতেই জন্মগ্রহণ করবেন। 

(গ) কবি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন এই বাংলায় হয়তো শঙ্খচিল অথবা শালিখের বেশে।  হয়তো ভোরের কাক হয়ে কুয়াশার বুকে ভেসে ভেসে আসতে চান - কাঁঠাল ছায়ায় কার্তিকের নবান্নের দেশে কিংবা হাঁস হয়ে আসতে চান -কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে তার সারাদিন কেটে যাবে। নদী -মাঠ -ঘাট ভালোবেসে কবি আবার আসতে চান জলঙ্গীর জলে ভেজা এই বাংলার সবুজ করুণ পেলব ডাঙায় ফিরে আসতে চান।    

(১১) " এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায় " 

(ক) কে ডিঙা বায় ? কোথায় ডিঙা বায় ? 

(খ) কীভাবে ডিঙা বায় ? 

(গ) কবির ঐকান্তিক ইচ্ছা কী ? 

উত্তরঃ 

(ক) কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত " আবার আসিব ফিরে " কবিতায় কবি বর্ণনা করেছেন এক কিশোর রূপসা নদীর ঘোলা জলে ডিঙা বায়।  

(খ) কিশোরটি রূপসার ঘোলা জলে ছেঁড়া পাল ডিঙাটি বেয়ে চলেছে।  অস্তমিত সূর্যের রক্তিম বর্ণে পশ্চিম আকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।  স্তরে স্তরে সঞ্চিত রক্তিম মেঘগুলিকে সাঁতরে অন্ধকার অতিক্রম করে নীড়ে ফিরে আসছে যে সাদা বক , কবির মনে হচ্ছে কিশোরটিও সাদা ছেঁড়া পাল নিয়ে তার নীড়ে ফিরে আসছে।  

(গ) কবির ঐকান্তিক ইচ্ছা কবিও জন্মান্তরে ওই কিশোরটির মতো কিংবা স্তরে স্তরে সজ্জিত রক্তিম বর্ণের মেঘের সমুদ্র পার হয়ে ওই সাদা বকটির মতো উড়ে আসবেন এই বাংলায়।  কবি জন্মান্তরে বাংলাকে ভালোবেসে বার বার ফিরে আসতে চান এই বাংলায়। 

(১২) আমাকেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে " 

(ক) প্রসঙ্গ কী ? 

(খ) 'ইহাদের ভিড়ে ' বলতে কী বোঝ ? 

উত্তরঃ 

(ক) কবি জীবনানন্দ দাশ " আবার আসিব ফিরে " কবিতায় বলেছেন তিনি জন্মান্তরে বিশ্বাসী।  তিনি আবার ফিরে আসবেন এই বাংলায় তাঁর জন্মভূমিতে।  কিন্তু কী রূপে আসবেন তা তিনি জানেন না।  এই প্রসঙ্গেই কবি প্রশ্নে উল্লিখিত উক্তিটি করেছেন।  

(খ) কবির বিশ্বাস তিনি মানুষ হয়ে না ফিরতে পারলেও কোনো ক্ষতি নেই।  ওই যে শঙ্খচিল , শালিক , হাঁস কিংবা লক্ষ্মীপেঁচা যাদের ডাক প্রতিনিয়ত শোনা যায় বাংলার বুকে -তাদের কারও একজনের রূপ ধরে ফিরে আসবেন গ্রাম বাংলার কোন এক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় , কিংবা কোন কিশোরীর হাঁস হয়ে অথবা যে সাদা বকটি রাঙা মেঘ সাঁতরিয়ে নিজের নীড়ে ফিরে আসছে তাদের সবার মাঝখানে কবিকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে কবি মনে করেছেন।  



















বাংলাভাষা


বাংলাভাষা  

অতুলপ্রসাদ সেন 

মোদের গরব , মোদের আশা ,  আ মরি বাংলা ভাষা। 

তোমার কোলে তোমার  বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা 

         কী জাদু বাংলা গানে ---

          গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে ! 

         এমন কোথা  আর আছে গো 

গেয়ে  গান নাচে বাউল , গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।  

          ওই ভাষাতেই নিতাই গোরা

 আনল দেশে ভক্তিধারা - ---

মরি হায় হায় রে ! 

আছে কই এমন ভাষা , এমন দুঃখ শ্রান্তিনাশা ! 

      বিদ্যাপতি , চন্ডী , গোবিন 

      হেম  মধু   বঙ্কিম  নবীন ---

আরও কত মধুপ গো ! 

ওই ফুলেরি মধুর রসে বাঁধল সুখে মধুর বাসা।  

বাজিয়ে রবি তোমার বীণে ,

আনল মালা  জগৎ জিনে -

গরব কোথায় রাখি গো ! 

তোমার চরণ -তীর্থে আজি জগৎ করে যাওয়া-আসা।  

        ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে 

          ডাকনু  মায়ে  "মা" "মা" বোলে ;

এই ভাষাতেই বলব "হরি " সাঙ্গ  হলে কাঁদা -হাসা। 

কবিতার সারসংক্ষেপ : 

'বাংলা ভাষা " কবিতাটি একটি গান বিশেষ।  এই গানটি কবির " গীতিগুঞ্জ " থেকে নেওয়া হয়েছে।  

                        বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব , আমাদের আশা -ভরসা।  এই ভাষার কাছে আশ্রয় নিয়ে , এই ভাষায় কথা বলে আমরা শান্তি ও ভালোবাসার সন্ধান পাই।  বাংলা গানের সম্মোহনী শক্তি আছে যা আমাদের বিভোর করে দেয়।  তাই মাঝি নৌকা চালায় , বাউল নেচে বেড়ায় , কৃষক ধান কাটে এই ভাষাতেই গান গেয়ে। গৌরাঙ্গ এবং নিত্যানন্দ এই ভাষাতেই কীর্তন গেয়ে দেশে ভক্তির জোয়ার এনেছিলেন।  কবির মতে বাংলা ভাষার মত এমন কোন ভাষা নেই যা আমাদের দুঃখ , ক্লান্তি সব কিছু দূর করে দেয়।  মা যখন  তার সন্তানকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করলে সন্তানের সমস্ত দুঃখ , কষ্ট , ক্লান্তি দূর হয়ে যায় বাংলা ভাষাও সেই রকম আমাদের মনকে সেই রকম শান্তি দেয়।  

         বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, হেমচন্দ্র , মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র , নবীনচন্দ্র ও আরোও অনেক বাংলার কবি সাহিত্যিক এই ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।  বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এই ভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি করে নোবেল পুরস্কার পেয়ে আমাদের গর্বিত করেছেন।  

       কবি বলেছেন তিনি জন্মগ্রহণ করে বাংলাযখন তিনি  ভাষাতেই প্রথম " মা" বলে ডেকেছেন , আবার এই ভাষাতেই " হরি " ডেকে জীবনের শেষ দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন।  


মনে রাখা দরকার : 

কবি এখানে তাঁর মাতৃভাষা বাংলার গুণগান গেয়েছেন।  নিজের মাতৃভাষা সবার কাছে খুব প্রিয়।  সেটা কারোর জন্য তামিল , কারোর জন্য হিন্দি  বা কারোর জন্য মারাঠী হতে পারে।  তাই মাতৃভাষা আমাদের সবার কাছে নিজের মা ও  জন্মভূমির মতো প্রিয় ও গর্বের বিষয়।  


ব্যাখ্যা : 


(১) তোমার কোলে , তোমার বোলে 

        কতই শান্তি ভালোবাসা। 

নিজের জন্মভূমিতে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার মতো শান্তি আর কিছুতেই নেই।  মা যেমন তাঁর সন্তানকে আদর করে কোলে তুলে নিলে সন্তানের সমস্ত দুঃখ , কষ্ট, শ্রান্তি দূর হয়ে যায় তেমনি মাতৃভাষাও তাঁর সন্তানকে কোলে ঠাঁই দেন।  

(২) কী জাদু বাংলা গানে --

গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে।  

কবির মতে , বাংলা ভাষার মধ্যে যেন কোনো জাদু আছে।  তাই তার আকর্ষণে নৌকোর মাঝি ভাটিয়ালি গান গেয়ে নৌকো বেয়ে নিয়ে যায়।  বাংলা নদীমাতৃক দেশ।  বাংলা দেশের মাঝিরা নৌকো চালাতে চালাতে যে লোকসঙ্গীত  গায় তার নাম ভাটিয়ালি।  

( " গান গেয়ে ধান কাটে চাষা"  ---  চাষীও ধান কাটার সময় বাংলা ভাষায় গান গায়।  

রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় বলেছেন :

ডিঙি চ'ড়ে  আসে চাষী , কেটে লয় ধান ,

বেলা গেলে গাঁয়ে ফেরে গেয়ে সারিগান "  ) 

(৩) গেয়ে গান নাচে বাউল ,

গান গেয়ে ধান কাটে চাষা 

" বাউল " বলতে বোঝায় ধর্মীয় সংকীর্নতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত সাধক সম্প্রদায়।  সংগীত এঁদের সাধনার অঙ্গ।  এঁরা প্রচলিত হিন্দু বা মুসলমান কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নন।  এই বাউলরা একতারা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।  

                      কবি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন যে , বাংলার মানুষ যে যে কাজই  করুক না কেন সে ভাগ্যে ভাতেই গান গেয়ে কাজের কষ্ট লাঘব করে ও মনের আনন্দে কাজ করতে পারে। 


(৪) ওই ভাষাতেই নিতাই গোরা 

   আনল দেশে ভক্তি ধারা 

বাংলা ভাষায় কীর্তন অর্থাৎ কৃষ্ণের গান গেয়ে দেশে ভক্তির ধারা এনেছিল নিতাই ও গৌড়।  

        চৈতন্যদেব এবং তাঁর পার্ষদ নিত্যানন্দ বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে বাংলাদেশে ভক্তিধারা এনেছিলেন।  প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে গিয়ে অর্থাৎ হিন্দু বা মুসলমান কোন ধর্মেই না থেকে তাঁরা কৃষ্ণনাম সংকীর্তনকেই একমাত্র ঈশ্বর সাধনার পথ বলে মনে করেছিলেন। এই আদর্শেই প্লাবিত হয়েছিল জাতি -ধর্ম -নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ।  নিতাই -গোরা বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল।  

      

(৫)"  আছে কই এমন ভাষা , এমন দুঃখ শ্রান্তি নাশা " 

কবির মতে , বাংলা ভাষায় যে জাদু আছে তা শুধু প্রকাশের মাধ্যম নয় - আত্মার সঙ্গে তার যোগ।  পরিশ্রমে ও সাধনায় - কৃষকের শ্রমে বা বাউলের সাধন সঙ্গীতে এই ভাষাই তাই একমাত্র অবলম্বন।  এই ভাষায় গান গেয়েই পাওয়া যায় আনন্দের সন্ধান , মনের মুক্তি ও প্রশান্তির সন্ধান।  তাই কবি এই ভাষাকে " দুঃখ শ্রান্তি নাশা " বলে বর্ণনা করেছেন।  


(৬) আরও কত মধুপ গো 

ওই ফুলেরি মধুর রসে বাঁধল সুখে মধুর বাসা 

বাংলা ভাষা যেন মধুতে ভরা ফুল আর বাংলার সব কবি সাহিত্যিক হলেন মধুপ অর্থাৎ মৌমাছি।  বিদ্যাপতি , চন্ডীদাস , গোবিন্দদাস , হেমচন্দ্র , মধুসূদন , বঙ্কিমচন্দ্র , নবীনচন্দ্রের মতো আরো কত কবি সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন।  

(৭) বাজিয়ে রবি তোমার বীণে 

  আনলো মালা জগৎ জিনে 

"রবি" বলতে এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বোঝানো হয়েছে।  বাংলা ভাষা যেন সাতটি তারের সুরে বাঁধা বীণা।  সেই বীণায় গান বেঁধে জগৎবাসীকে  মন জিতে বাংলার জন্য জয়ের মালা এনে দিয়েছিলেন।  

              যদিও " গীতাঞ্জলি" র ইংরাজী অনুবাদ করে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন।  কিন্তু তাঁর কবি প্রতিভার বিচিত্র বিকাশ এই বাংলা ভাষাতেই হয়েছিল।  তাই কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের  নোবেল পুরস্কার পাওয়া আসলে বাংলা ভাষারই বিশ্বজয়।  

(৮) " ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে ,

        ডাকনু 'মা' 'মা' বোলে ;

এই ভাষাতেই বলব 'হরি' সাঙ্গ  হলে কাঁদা-হাসা। " 

প্রতিটি শিশু তার মায়ের মুখের ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষাই প্রথম শেখে।  মায়ের মুখের ভাষা দিয়ে তার জীবন চলা শুরু হয়।  'মা' ডাক আর মাতৃভাষায় কথা বলা এখানে সমার্থক হয়ে গেছে।  

            আবার যেদিন এই পৃথিবীতে  জীবনের সমস্ত বোঝাপড়া শেষ হয়ে আমরা অমৃতধামে যাত্রা করব সেদিন এই মায়ের ভাষাতেই ঈশ্বরকে স্মরণ করব। 


প্রশ্ন ও উত্তর :  


(১) বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি কেন ? 

উত্তরঃ 

আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষা আমাদের গর্ব।  আমাদের আশা -ভরসা , মনের যাবতীয় ভাব আমরা এই ভাষাতেই প্রকাশ করি।  এই ভাষায় গান গেয়ে মাঝি নৌকা বায় , কৃষক ধান কাটে ,বাউল তার মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায়।  গৌরাঙ্গ এবং নিত্যানন্দ এই ভাষাতেই কীর্তন গেয়ে দেশে ভক্তির জোয়ার এনেছিলেন।  বিদ্যাপতি , চন্ডীদাস , গোবিন্দদাস , হেমচন্দ্র , মধুসূদন , বঙ্কিমচন্দ্র , নবীনচন্দ্র  ও অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক এই ভাষাতেই কাব্য ও সাহিত্য রচনা করে খ্যাতিলাভ করেছেন।  রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছেন নোবেল পুরস্কার।  

(২) বাউল কাদের বলে ? 

উত্তরঃ 

ধর্মীয় সংকীর্নতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত সাধক সম্প্রদায়।  সঙ্গীত এঁদের সাধনার অঙ্গ।  এঁরা প্রচলিত হিন্দু অথবা মুসলমান কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নন।  

(৩) " কী জাদু বাংলা গানে " 

(ক) এই ' জাদু ' র টানে মাঝি  কী করেন ? 

(খ) বাউল কী করেন ? 

(গ) চাষী কী করেন ? 

উত্তরঃ 

(ক) এই জাদুর টানে মাঝিরা 'ভাটিয়ালি ' গান গেয়ে নৌকা বায়।মাঝি দাঁড় টেনে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যায়।  একাজ খুব পরিশ্রমের।  কিন্তু বাংলা গানের এমন জাদু মাঝির সেই পরিশ্রম দূর হয়ে যায় বাংলার প্রাণ মাতানো গানে।   

(খ) বাউলরা গান গেয়ে ঈশ্বরের সাধনা করেন। 

(গ) চাষীও ধান  কাটতে কাটতে বাংলার সারিগান গায়।  

( রবি ঠাকুরের কবিতায় আছে :

" ডিঙি  চ'ড়ে আসে চাষি, কেটে লয় ধান,

বেলা গেলে গাঁয়ে ফেরে গেয়ে সারিগান " ) 







 








 




ইলিয়াস

 ইলিয়াস 

লিও তলস্তয় 


আজ আমি নবম শ্রেণির পাঠ্য লিও তলস্তয়ের লেখা " ইলিয়াস " গল্পটির  মূল বিষয়বস্তু সম্পর্কে আলোচনা করব।  " ইলিয়াস " গল্পটি নেওয়া হয়েছে লেখকের Twenty Three Tales গল্প সংকলন থেকে। 

     গল্পটি একজন পরিশ্রমী , কর্মঠ , সাধারণ ভালো মানুষের জীবন উপলব্ধির কাহিনি।  গল্পের প্রধান কেন্দ্রীয় চরিত্র ইলিয়াস।  ঊনবিংশ শতাব্দীতে , আর্থ-সামাজিক সমাজ ব্যবস্থা যখন সামন্ততান্ত্রিক থেকে পুঁজিবাদীতে পরিবর্তিত হচ্ছিল তখন সাধারণ লোকেদের জীবন ধারণের জন্য প্রচুর কাজ করতে হত।  পরিবারের জন্য , ঈশ্বর চিন্তার জন্য কোন সময় থাকত না. ইলিয়াস ও তার স্ত্রীর জীবনও সেই রকম ছিল।  প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , এখনও মানুষের জীবন সেইরকমই।  

                           গল্পটিতে আমরা দেখতে পাই যে ইলিয়াস এমন একজন মানুষ যে নিজের অক্লান্ত পরিশ্রম , প্রচেষ্টা ও সুব্যবস্থাপনায় প্ৰভূত সম্পত্তি অর্জন করেছিল।  ধনী অবস্থায় সে ছিল অত্যন্ত অতিথি বৎসল ও দয়ালু মানুষ।  কিন্তু গল্পের শেষে দেখা যায় ভাগ্যের ফেরে সে একজন কপর্দকহীন মানুষে পরিণত হয়েছে।  সে ও তার স্ত্রী তার প্রতিবেশীর বাড়িতে ভাড়াটে মজুরের মত কাজ করে জীবন কাটাচ্ছিল।  কিন্তু সেই নিয়ে ইলিয়াস ও তার স্ত্রী শাম-শেমাগির কোন আফশোস ছিল না।  বরং গল্পের শেষে তার স্ত্রীর জবানীতে আমরা জানতে পারি তাদের দুজনের জীবন -উপলব্ধির কথা।  ধনসম্পত্তি থাকলেও মনে শান্তি ছিল না ইলিয়াস দম্পতির।  অর্থ , লোকবল , সম্পত্তি ইত্যাদি প্রাচুর্যের মধ্যেও ছিল দুশ্চিন্তা ও অশান্তি।  সম্পত্তি হারিয়ে শাম-শেমাগি ও  ইলিয়াস  প্রকৃত সুখ ও সত্যের তাৎপর্য বোঝে।  তখন ভাড়াটে মজুর হিসেবে কাজের বিনিময়ে অন্ন- বাসস্থান পেলেও স্বামী-স্ত্রীতে একান্তে মনের কথা আলোচনা করার মত সময় পেত।  ঝগড়া ও দুশ্চিন্তার বদলে মনিবের কাজেই তাদের অধিকাংশ সময় কেটে যেত।  মনের কথা আলোচনা করা ও ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করারও অবকাশ ছিল।  তাই শাম -শেমাগির এই উপলব্ধি হয় যে , পঞ্চাশ বছরের দাম্পত্য জীবনে সুখ খুঁজে খুঁজে এতদিনে তারা হদিশ পেয়েছে।  

              এই গল্পটি আমাদের এক চিরকালীন সত্যের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।  সম্পদ ও বৈভব থেকে মানুষের মনের শান্তি পাওয়া যায় না।  বরঞ্চ দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনই শান্তির বার্তা নিয়ে আসে।  আপন লোকেদের সাথে সময় কাটানো , ঈস্বরচিন্তা ও আত্মচিন্তাই মানুষকে সঠিক শান্তি দিতে পারে ও মনকে আনন্দে ভরে তুলতে পারে।  

জীবনে কিছুই চিরস্থায়ী নয়।  তাই সুখের মতো দুঃখকেও হাসিমুখে মেনে নিতে পারলেই শান্তির সন্ধান  পাওয়া সম্ভব।  












 


     

স্বাধীনতার সুখ

 





 
স্বাধীনতার সুখ 

রজনীকান্ত সেন 

কবিতার কথা : 

বাবুই পাখি গাছে বাসা বানিয়ে তাতে বাস করে।  চড়ুই পাখি থাকে দালানের আনাচে কানাচে বা ঘুলঘুলিতে বাসা বেঁধে।  গাছের ওপর বাসা , তাই ঝড়-জল -রোদে বাবুই পাখিকে কষ্ট পেতে হয়।  চড়াই পাখির সে ঝামেলা নেই।  ঝড়বৃষ্টির সময় পাকা বাড়ির নিরাপদ বাসায় আশ্রয় নিলেই হল।  বাবুই পাখিকে ডেকে চড়াই এই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়ে বলছে , বাবুই তার সুন্দর বাসাটি নিয়ে যতই গর্ব করুক , ওই বাসায় থেকে সুখ নেই।  তার চেয়ে বরং পাকা বাড়িতে তার মতো থাকাই ভালো।  ঝড়জলে কষ্ট পেতে হয় না।  এই কথা শুনে , বাবুই বলল , চড়াই যা বলছে তা ঠিকই , তবে , পরের বাসায় আরাম করা থাকার চাইতে নিজের বাসায় কষ্ট করে থাকা অনেক ভাল।  

  এই কবিতা টি থেকে আমরা শিখতে পারি যে সুখ নির্ভর করে মনের উপর।  মনে যার সুখ আছে সেই প্রকৃত সুখী।  যারা স্বাবলম্বী তারা এই সুখ পায় , যারা অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকে তারা এই সুখ পায় না।  

প্রশ্ন : 

(১) চড়াই পাখি কোথায় থাকে ? 

(২) চড়াই পাখির মনে এত আনন্দ কেন ? 

(৩) বাবুই পাখির বাসাকে তার খারাপ মনে হয় কেন ? 

(৪) বাবুই পাখির বাসা কে তৈরি করে ? 

(৫) বাবুই পাখিকে ডেকে চড়াই পাখি কী বলল ? 

(৬) চড়াই -এর কথার উত্তরে বাবুই কী বলেছিল ? 

(৭) বাবুই ছোট্ট বাসায় থেকেও দুঃখ না করে আনন্দ প্রকাশ করল কেন ? 

 






ঘোষাল পুকুর

 




                           ঘোষাল পুকুর 

কুমুদরঞ্জন মল্লিক 






মনে রাখার বিষয় : 

কালো জল :

 জলের কোন রং হয় না।  কিন্তু পুকুরের পাশে প্রচুর গাছপালা থাকায় তাদের ছায়া জলে পড়ায় জল কালো দেখায়। 


ঘোষাল পুকুর : 

ঘোষাল একটি পদবি বিশেষ।  পুকুরটি ঘোষালদের।  তাই গ্রামে সবাই পুকুরটিকে ঘোষাল পুকুর নামেই চেনে। 

ছেলেরা ঘুরিছে :

তাল ফল সবার কাছেই খুব প্রিয়।  এই ফল দিয়ে অনেকরকম মিষ্টি তৈরি হয়।  সেই কারনে পাকা তাল কুড়োনোর জন্য ছেলেরা সবসময় ঘোষাল পুকুরের ধরে সবসময় ঘুরে বেড়ায়।  

"এ পুকুর কিনেছি আমরা " 

যেহেতু পুকুরটি ওই ছোট ছেলেটির বাড়ির লোক কিনে নিয়েছে , সেইজন্য পুকুরপাড়ের তালগাছের এবং তার ফলের মালিক তারা।  এই তালের ওপর টুনির কোনো অধিকার নেই।  

" শুধু এই দুটি কথা শুনি " 

টুনি পুকুর ধার থেকে দুটি তাল কুড়িয়েছিল।  কিন্তু সেই সময় অন্য একজন বালক জোর করে তাল দুটি নিতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। তখন সেই বালক জানায় যে তারা পুকুরটি কিনেছে।  টুনি এই দুটো কথা শুনে মুহূর্তে বুঝতে পারে এই তালের ওপর তার কোন অধিকার নেই।  

প্রথম জাগিল মার বুকে :

পুকুরটি একদা তাদের ছিল , কিন্তু অর্থের প্রয়োজনে তারা বিক্রি করতে বাধ্য হয়।  আজ টুনিকে তাল ফেরত দিতে বাধ্য হতে দেখে মার মনে কষ্ট হয়।  


শব্দার্থ : 

ঢলঢল - লাবণ্যময় 

ধারে - পাশে 

বাঁধাঘাটে -ইটের তৈরী ঘাট ,  পুকুরের ঘাট শান বাঁধানো 

রাখাল - যারা গোরু চড়ায় 

লাগি - জন্য 

সবলে - জোর করে 

বুকে চাপি- বুকের কাছে ধরে রাখা 

ম্লান - মলিন , করুণ 

বেচা - বিক্রি করা 

জাগিল - অনুভব করল 

বুকে- মনে 


প্রশ্ন : (১) ঘোষাল পুকুরটি কেমন দেখতে বর্ণনা কর। 

উত্তরঃ গ্রামের পথের ধারেই রয়েছে ঘোষাল পুকুর।  স্বচ্ছ জলে পূর্ণ পুকুরটির

পাড়ে রয়েছে সারি সারি তালগাছ। সকাল বিকাল   ছোটো ছোটো রাখাল

বালকেরা পুকুরটির বাঁধানো ঘাটে খেলা করে। তাল পেকে গাছ থেকে পড়লেই

সেগুলো কুড়াবার জন্য ছোটোরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।  

(২)  “ কাছে গেল শিশু ম্লানমুখে” 

(ক) কোন কবিতার অংশ ? কার লেখা ? 

(খ) শিশুটি বলতে কার কথা বলা হয়েছে ? 

(গ) শিশুটি ম্লান মুখে কার কাছে গেল ? 

(ঘ) শিশুটির   ম্লানমুখ ছিল কেন ? 

উত্তরঃ

(২)  ( ক)  কুমুদরঞ্জন মল্লিকের লেখা “ ঘোষাল পুকুর” কবিতার অংশ।  

(খ) শিশুটি বলতে এখানে টুনীকে বোঝানো হয়েছে।  

(গ) শিশুটি ম্লান মুখে তার মায়ের কাছে গেল।  

(ঘ) টুনী ঘোষাল পুকুরটির পাড় থেকে দুটি তাল কুড়িয়ে পেয়েছিল। 

কিন্তু অন্য একটি শিশু টুনীর কাছ থেকে জোর করে কেড়ে নিতে চায়। 

কিন্তু শক্তিতে সে পেরে ওঠে না।  তখন সে বলে ওঠে যে ওই পুকুরটি তারা

কিনে নিয়েছে।  টুনী তখন ভারাক্রান্ত হৃদয়ে তাল দুটি নামিয়ে রাখতে বাধ্য হয়। 

তাই তার ম্লান মুখ ছিল।  



বনভোজন

 বনভোজন 

কুমুদরঞ্জন মল্লিক 


বনভোজন  কথাটির অর্থ হল চড়ুইভাতি। গাছপালায় ঘেরা কোনো সুন্দর জায়গায় সবাই মিলে  রান্নাবান্না করে খাওয়া দাওয়া করা, আনন্দ করা , খেলাধুলা , গান বাজনা করে প্রকৃতির মধ্যে কাটানোর নামই হল বনভোজন।  

      ছোট ছেলেরা মাঠে একটি নদীর পাশে চড়ুইভাতি করছে।   খাওয়া -দাওয়ার দিকে তাদের বেশি মন নেই।  নিজেদের মধ্যে আনন্দ -কোলাহল করে সময় কাটাতেই তারা ব্যস্ত। কেউ বা অনভস্ত্য ভাবে উনান ধরাতে গিয়ে চোখ লাল করে ফেলছে। কেউ বা গাছের শুকনো মোটা সরু দল ভেঙে আনছে।  পায়েস তৈরি করার জন্য তাদের কাছে আতপ চাল, দুধ , নলেন গুড় সবই আছে , কিন্তু তার থেকেও বেশি তাদের কাছে আছে বন্ধুদের সঙ্গ ও আনন্দ। কেউ বা নদীতে সাঁতার কেটে জলে ঢেউ তুলছে , কেউ বা কাঁচা মিঠে রোদে ডিগবাজি খাচ্ছে। বট গাছের ঝুড়িতে দোল খেতে খেতে কেউ বা গান গাইছে।  

                  বন্ধুরা মিলে  সবাই এতই আনন্দে মত্ত যে দিন যে শেষ হয়ে আসছে তার খেয়াল নেই।  

😀 এই কবিতাটির সঙ্গে মিলিয়ে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়  লেখা " বনভোজনের ব্যাপার " গল্পটি পড়লে আমার মনে হয় ছাত্র ছাত্রীরা খুবই মজা পাবে।    




রথযাত্রা

 


রথযাত্রা :  

মনে রাখার বিষয় :  

    • রথযাত্রা " গল্পটি নেওয়া হয়েছে " লিপিকা " গ্রন্থ থেকে 
    • " রথযাত্রা " প্রসঙ্গে গীতাঞ্জলির কবিতা বিশেষ ভাবে স্মরণীয় :    
    •     (১) এসো হে পতিত করো অপনীত /সব অপমানভার 
    •     (২) যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন / সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে / সবার পিছে , সবার নীচে,/ সব-হারাদের মাঝে 
    •   (৩)  'হে মোর দুর্ভাগা দেশ , যাদের করেছ অপমান / অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

গল্প শুরু হয় রথযাত্রার দিন।  রাজা ও রানি রথ দেখতে যাবেন।  তাই তার প্রস্তুতি শুরু হল।চারিদিকে 'সাজো' ' সাজো 'রব উঠল।    ঘোড়াশালা থেকে ঘোড়া , হাতিশালা থেকে হাতি এল।  ময়ূরপঙ্খী সাজান হল।  বল্লম হাতে সারি সারি সিপাই সান্ত্রী , দাস-দাসী সবাই রাজা -রানির সঙ্গে চলল।  কেবল একজন গেল না---দুঃখী গেল না রাজার সাথে।  দুঃখীর কাজ হল রাজবাড়িতে ঝাঁটার কাঠি কুড়িয়ে আনা। সর্দারের দয়া হল।  সে দুঃখীকে তাদের সঙ্গে যেতে বলল।  কিন্তু দুঃখী বলল তার যাওয়া হবে না।  রাজামশাই জানতে পারলেন।  সবাই যাচ্ছে , শুধু সেই দুঃখী যাচ্ছে না।  রাজামশায়েরও দয়া হল।  তিনি মন্ত্রীকে বললেন দুঃখীকে ডেকে নিতে। দুঃখীর বাড়ি রাস্তার ধারে। রাজার হাতি যখন সেখানে পৌঁছল তখন মন্ত্রী তাকে ডেকে তাদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতে বললেন।  দুঃখী বলল ঠাকুরের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছায় তার সাধ্য নেই।  মন্ত্রী তাকে অভয় দিয়ে বলল সে রাজার সঙ্গে যাবে কাজেই তার কোন চিন্তা নেই।  দুঃখী উত্তরে জানাল রাজার পথ আর তার পথ এক হতে পারে না।  মন্ত্রী বললেন তাহলে দুঃখীর ভাগ্যে কী করে "রথযাত্রা " দর্শন হবে।  দুঃখী মন্ত্রীকে জানাল ঠাকুর রথে করে তার দুয়ারেই আসেন।  দুঃখীর এই কথায় মন্ত্রী হেসে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন তার দুয়ারে ঠাকুরের রথের চিহ্ন কোথায়।  দুঃখী তাঁকে জানায় তার দুয়ারে ঠাকুর আসেন পুষ্পক রথে করে তাই  ঠাকুরের রথের চিহ্ন পড়ে না।  সে তার দুয়ারের দুই পাশে দুটি সূর্যমুখী ফুল দেখিয়ে বলে ঐটাই ঠাকুরের রথ।  
         "রথযাত্রা " রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতীকি  গল্প। ছোট এই গল্পটির মাধ্যমে কবি একটি বড়ো সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।  
            পুষ্পক রথ পুষ্পেরই রথ।  সূর্যমুখী ফুল অর্থাৎ সূর্যের রথ।  দুই পাশে দুটি সূর্যমুখী সেই পুষ্পরথের হলুদে আর কালোয় বলয়িত দুটি চাকা। সূর্যের আলোয় ফুটে ওঠা পৃথিবীর ফুল যেমন অত্যন্ত স্বাভাবিক , নির্মল তেমন দুঃখীর মত যারা মাটির কাছের মানুষ তারাও ঈশ্বরের করুণা থেকে কখনও বঞ্চিত হয় না।  ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য তাদের রাজা , মন্ত্রী বা সর্দারের দয়ার কোন প্রয়োজন নেই।  ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান।  তাই তাঁকে দেখার জন্য কোন অয়োজনের প্রয়োজন পরে না।  মনের চোখ থেকে দেখলে আমাদের আশেপাশেই তাঁকে দেখা যায়।   



আহ্বান

 আহ্বান 

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য 

"আহ্বান " কবিতাটি কবি সুকান্তর " অভিযান " কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।  " অভিযান " কাব্যগ্রন্থে "সূর্যপ্রণাম " কাব্যের একটি অংশ "আহ্বান" । এটিকে কবি সমবেত গান হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।  

      কিশোর কবি সুকান্ত দেশের যুবসমাজকে ডাক দিয়েছেন সবাইকে পথে নেবে একসাথে চলার জন্য।  নতুন দিনের সূর্য সবাইকে  আহ্বান জানাচ্ছে। আকাশ সূর্যের আহ্বান অগ্রাহ্য করে কেই বা ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারে !  পৃথিবীর সবাই এগিয়ে চলেছে , আমাদের তাদের সঙ্গে সমান তালে পা মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।  পিছিয়ে পড়লে চলবে না।  সকাল -সন্ধ্যা সূর্য আমাদের পথের সঙ্গী হয়ে চলেছে।  

        ঘুম ভেঙে জেগে ওঠ।  পথে নেবে পথের সাথী ও পথ উভয়কেই চিনে নিতে হবে।  পিছনের দিকে তাকালে চলবে না।  নতুন দিনের  জয়ের পথে সবাইকে নিয়ে সবাই এগিয়ে চলতে হবে।  যারা নতুন দিনের মানুষ তাদের চোখেই ফুটে উঠবে সফলতার আলো।  আর তাদের সফলতার মধ্য দিয়ে আসবে নতুন দিনের সূর্য।  নতুন পৃথিবী সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে।  



জীবনভিক্ষা - করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়

 কবিতার সারাংশ :

কিসা গৌতমীর একমাত্র শিশুপুত্রটি মারা গিয়েছে।  শিশুপুত্রের মৃত্যুতে সে পাগলপ্রায়। পুত্রের মৃতদেহ নিয়ে   মন্দিরে মন্দিরে সে তার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের জীবনের জন্য ঘুরে বেড়াল।  কিন্তু ব্যর্থ হল।  আপন জীবন দিতেও সে প্রস্তুত ছিল পুত্রের জীবনের জন্য।  তার দুধের বাছা চোখ মেলল না।  অবশেষে সে  পরমপুরুষ  গৌতম বুদ্ধের কাছে গেল।বুদ্ধদেব সমগ্র পৃথিবীর " ত্রিতাপ দুঃখ " ( অর্থাৎ আধ্যাত্মিক , আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক ) হরণ করেছেন। সেইজগতদুর্লভ  জীবের দুঃখহারী বুদ্ধদেবকে তার  পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিতে প্রার্থনা জানাল।  গৌতম বুদ্ধ বললেন ,তার পুত্র " নীরব সমাধি মগ্ন " , সে চিরসুন্দর মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে।  এমন যদি কোনো ঘর থেকে থাকে যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করেনি , তবে সেখান থেকে কিছুটা সর্ষে নিয়ে এলে তার স্পর্শে পুত্রটি প্রাণ ফিরে পাবে।কিসা গৌতমী দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াল , কিন্তু একটি ঘরও পেল না যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করেনি।  ফিরে এল সে গৌতম বুদ্ধের কাছে।  জানাল, তার মোহ -বিরহ তিরহিত।  সে বুঝেছে যে মৃত্যু জীবন মাত্রেই আছে , মৃত্যুকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।  মৃতের প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা তাই বৃথা।  সে তার মৃত পুত্রের জীবন চায় না।  জগতের বিরহ দুঃখ হরণকারী বুদ্ধদেব তাকে যেন "অমৃত দীক্ষা" দেন।  



  

আগামী



"আগামী" 

কবি - সুকান্ত ভট্টাচার্য 
 কবিতার সারাংশ
আজ যে বীজ অংকুরিত  , সে চিরকাল চারাগাছটি থাকবে না ।তার মধ্যে রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। আপন শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তার আত্মবিশ্বাসও যথেষ্ঠ রয়েছে । বৃহতের আহ্বানে সে চোখ মেলে তাকিয়েছে।
অনেক বড় কিছু করবার পরিকল্পনা আছে তার । সে  আজ দুর্বল ও নগণ্য;  তাই বলে সে অবহেলার পাত্র নয়। একদিন সেও মহীরূহে পরিণত হবে। ধীরে ধীরে সে বিকশিত হবে। পাতা মেলবে, মাথা নাড়বে, শাখা ছড়াবে।  প্রতিবেশী গাছদের সামনে ফুল ফোটাবে। আত্মশক্তিতে সে সম্পূর্ণ বলবান হবে। ঝড়ের আঘাত হার মানবে তার কাছে। নবজাতকের দলকেও সে আহ্বান জানাবে --বলবে এগিয়ে আসতে।  অনতিকাল পরে, হয়তো আগামী বসন্তেই সে মহীরুহদের দলে মিশে যাবে।  তখন অন্যরা তার জয়ধ্বনি করবে। সে যখন সম্পূর্ণরূপে আত্মবিকাশ করবে , তখন মানুষ হয়তো তার অঙ্গচ্ছেদন করবে। কিন্তু তবু সে তাদের ছায়া দানে , ফল দানে , পাখির কূজন দানে বঞ্চিত করবে না।  কারণ সে সবার কাছে তাদের আপনজন হয়ে থাকতে চায়।  




সওগাত

 সওগাত 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

 মনে রাখার বিষয় :  

    • "সওগাত" গল্পটি  " লিপিকা" কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।  
    • "সওগাত " কথাটির অর্থ হল " উপঢৌকন "
    • "সওগাত " কথাটি একটি ফারসী শব্দ। 
শরৎ কাল প্রিয় সম্মিলনের ঋতু।  এই সময় প্রবাসী ( প্রবাসী অর্থাৎ যারা কর্মসূত্রে বা অন্য কোন কারণে দেশ ছেড়ে দূরে থাকে )  চায় নিজের ঘরে ফিরতে। মা দুর্গা যেমন এই সময় তাঁর মার কাছে ফিরে আসেন , তেমনই সবাই চায় তার মায়ের কাছে ফিরে আসতে।  পুজোর গন্ধর সঙ্গে মায়ের গন্ধ মিশে থাকে। তাই "রবীন্দ্রনাথের " মনে পড়া " কবিতাতে পুজোর গন্ধ মায়ের গন্ধ হয়ে যায়।  
             গল্পের শুরুতে দেখা যায় পুজোর সময়েও বাড়ির ছেলেরা সবাই মায়ের থেকে দূরে রয়েছে।  একমাত্র মায়ের কোলের ছেলেটি মায়ের কাছে আছে।  মা তার সেই দূরে থাকা ছেলেদের জন্য , কুটুম্বদের জন্য নানা উপঢৌকন পাঠাচ্ছেন।  বেনারসী কাপড়, সোনার অলঙ্কার , ভান্ড  ভরে ক্ষীর দই, পাত্র ভরে মিষ্টান্ন। মায়ের থেকে দূরে থাকা ছেলেরা মায়ের স্নেহের বদলে রাশীকৃত জিনিস পেয়েছে যা অর্থমূল্যে অতি সহজেই কিনতে পাওয়া যায়।  ছোটছেলেটি উপঢৌকনের বাইরের চাকচিক্য দেখে আকর্ষিত হয়ে মার কাছে গিয়ে অনুযোগ জানাচ্ছে। মা তখন সবথেকে মূল্যবান উপহার "মায়ের স্নেহচুম্বন  "  শুধু ছোট ছেলেটিকে দেয়।  মায়ের স্নেহ যা শুধুমাত্র মায়ের কাছেই পাওয়া যায়।  
            এই হচ্ছে মায়ের দেওয়া সেরা " সওগাত " তার সন্তান কে।  



( উৎসাহী ছাত্রছাত্রীদের জন্য : 
 .সুন্দর রঙবেরঙের ঢাকা দেওয়া সওগাত গুলি দেখে .ছেলেটির মন  উৎসুক হয়ে উঠেছিল    অথচ মায়ের হৃদয়ের দানের তুলনায় তাঁর এই পুজোর পরবের দান  যে কত মূল্যহীন তা  বোঝানোর জন্য সব সওগাত চলে যাওয়ার পর দিনান্তের অসামান্য একটি সাংকেতিক রূপকল্প সৃষ্টি হয়েছে : 
"দিনের শেষ নৈবেদ্যের সোনার ডালি নিয়ে সূর্যাস্তের শেষ আভা নক্ষত্রলোকের পথে নিরুদ্দেশ হল " 

সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় যে মায়াবী আলোর ও দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা অত্যন্ত সাময়িক।  কিছু সময় পরেই তা বিলীন হয়ে যায়।  সেই রকম মায়ের পাঠানো দামী ও সুন্দর দ্রব্যগুলি একদিন শেষ হয়ে যাবে রয়ে যাবে শুধু মায়ের স্নেহ , মায়ের আদর যা একমাত্র পেল মায়ের কাছে থাকা  কোলের ছেলেটি।  ) 



তোতাকাহিনী (সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা )

 সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা : 

(১) " সে গান গাহিত , শাস্ত্র পড়িত না " 

প্রসঙ্গ : 

 যে পাখিটির করুণ কাহিনি  লেখক লিপিবদ্ধ করতে চলেছেন , সেই তোতাপাখিটির স্বভাব -বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আলোচ্য কথাটি বলেন।  

সরলার্থ : 

তোতাপাখিটি সর্বক্ষণ লাফাত , উড়ত , গান গাইত।  কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়ত না, সামাজিক কোনো রীতিনীতিরও ধার ধারত না।  সে ছিল " মূর্খ ". বনের মধ্যে নিজের খেয়ালখুশি মতোই জীবন কাটাত।  

তাৎপর্য : 

মানবশিশুর জীবনও স্বাধীন তোতাপাখির মতো।  হাঁটতে চলতে এবং কথা বলতে শেখার পরই তাই সে মনের খুশিতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়।  নিজের আনন্দেই কথা বলে ও গান গায়।  সমাজের রীতিনীতি সে বোঝে না , বুঝতেও চায় না, এমনকি লেখাপড়াও করে না।  সর্বক্ষণই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর থাকে সে।  

(২) এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়। " 

প্রসঙ্গ : 

আলোচ্য রচনায় যে পাখিটির করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে , সেই তোতাপাখিটি সম্পর্কে রাজার মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে তাঁরই জবানিতে স্বয়ং লেখক উল্লিখিত উক্তিটি করেছেন। 

সরলার্থ :

বনের তোতাপাখিটি মনের আনন্দেই বনের ফল খেত।  ফলে ফলের ব্যাবসায় রাজার ক্ষতি হত।  পাখিটি তাঁর কোন কাজেই লাগত না।  ব্যবসা বুদ্ধিসম্পন্ন রাজার কাছে তাই তোতাপাখিটি ছিল এক মূর্তিমান লোকসান।  

তাৎপর্য : 

এ গল্পের রাজা পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির প্রতিভূ।  এই শাসকশ্রেণি তাদের শ্রেণিগত লাভ-লোকসানের নিরিখেই বিচার করে জনগণ এবং জনগণের কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনাকে।  শাসকশ্রেণির স্বার্থবিরোধী মানুষ তাদের চোখে ক্ষতিকারক ও অপ্রয়োজনীয়।  

(৩) " পাখিটাকে শিক্ষা দাও " 

প্রসঙ্গ : 

মূর্খ পাখিটা সবসময় আপন খেয়াল খুশিতে লাফাত, উড়ত, গান গাইত।  কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়ত না , সামাজিক কোনো রীতিনীতিরও ধার ধারত না সে।  রাজার চোখে এমন পাখি অকাজের।  তা ছাড়া বনের ফল খেয়ে সে তাঁর ফলের ব্যবসাতেও ক্ষতি করে।  তাই মন্ত্রীকে তিনি এমন আদেশ দিয়েছেন।  

সরলার্থ :

পাখির সহজ প্রাণচাঞ্চল্যকে অনিয়ম ও অভব্যতা বলে মনে হয়েছিল বস্তুবাদী রাজার।  তাই সমাজের যান্ত্রিক নিয়মের ছাঁচে ফেলে তাকে শিক্ষিত ও পরিণত করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি।  

তাৎপর্য : 

পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণি , এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর পিতামাতাও শিশুদের সহজ আনন্দের প্রকৃতিপাঠে আগ্রহী নন।  তবে তাঁরা উভয়েই শিশুকে শিক্ষা দিতে চান।  শাসকশ্রেণি শিশুকে দিতে চায় কেরানি হয়ে ওঠার উপযোগী শিক্ষা এবং শাসকশ্রেণির বিরোধিতার উপযুক্ত শাস্তি।  জৈবিকতা থেকে মানবিকতায় উত্তরণের শিক্ষা এ নয়।  


(৪) "  শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ" 

প্রসঙ্গ : 

পাখির জন্য তৈরি সোনার খাঁচাটির কারুকার্যে  আকৃষ্ট হয়ে দেশ- বিদেশ থেকে দলে দলে লোক আসতে শুরু করেছিল।  তাদের মধ্যে কেউই ভাবতে পারেনি যে, সামান্য পাখির শিক্ষার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে এমন এক অভিনব খাঁচা বানানো যেতে পারে।  তাই আগন্তুক দর্শনার্থীদের একজন খাঁচা দেখে বিস্মিত হয়ে উক্তিটি করেছিলেন।  

সরলার্থ : 

"হদ্দমুদ্দ " কথাটির অর্থ হল চরম বা চূড়ান্ত বা একশেষ।  প্রকৃতপক্ষে , একটি তোতাপাখির শিক্ষার জন্য যে এমন অসাধারণ সোনার খাঁচা তৈরি করা যেতে পারে , তা ভাবতেই পারেনি কেউ।  আশ্চর্য ও অভিভূত হয়ে বক্তা তাই জানিয়েছেন যে , খাঁচাটি শিক্ষাব্যবস্থার একেবারে চূড়ান্ত নিদর্শন। 

তাৎপর্য : 

বক্তা এখানে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যানিকেতনের অলংকরণ ও বিশালতাই সাধারণ মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।  কিন্তু তারা এ কথা বুঝতে পারেনি যে , চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি করে শিক্ষার্থীর শরীর-মনের সার্থক বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।   


(৫) "অল্প পুঁথির কর্ম নয় " 

প্রসঙ্গ : 

অত্যাশ্চর্য সোনার খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিটিকে পন্ডিত যখন শিক্ষা দিতে বসলেন তখন তিনি পুঁথির অপ্রতুলতা অনুভব করলেন।  নাকে নস্যি নিয়ে প্রথমেই তিনি পুঁথির অপ্রতুলতা অনুভব করলেন।  নাকে নস্যি নিয়ে প্রথমেই তিনি প্রশ্নে উল্লিখিত অভিমতটি প্রকাশ করেন।  

সরলার্থ : 

পুঁথি বলতে আমরা মুদ্রণ-পূর্ব -যুগের হাতে-লেখা গ্রন্থকেই বুঝি।  আলোচ্য গদ্যে পন্ডিত মনে করেছিলেন যে , পাখিটিকে যথার্থভাবে শিক্ষিত করে তুলতে রাশি রাশি পুঁথির প্রয়োজন।  যত বেশি-সংখ্যক পুঁথি পাখিকে পড়ানো হবে সে তত বেশি শিক্ষিত হবে।  

তাৎপর্য :

ইংরেজপ্ৰবৰ্তিত আধুনিক শিশুশিক্ষার  অন্যতম বৈশিষ্ট হল শুকনো তথ্যসমৃদ্ধ পাঠ্যগ্রন্থের সংখ্যাধিক্য।  শিক্ষকেরা করতেন যে , ছাত্ররা যত বেশি-সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পড়বে , তাদের বিদ্যার পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাবে।  তাঁরা ভেবে দেখেন নি যে , পাঠ্যপুস্তকের পাহাড়প্রমাণ চাপ  কেবল শিক্ষার্থীর চিন্তা চেতনার বিকাশই রুদ্ধ হয় না , তার স্বকীয়তা নষ্ট হয়।  


(৬) "শাবাস ! বিদ্যা আর ধরে না ! " 

প্রসঙ্গ : 

সোনার খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিটিকে শিক্ষা দিতে গিয়ে পন্ডিত উপদেশ দিয়েছিলেন পুঁথির সংখ্যা বাড়ানোর।  লিপিকররা বিভিন্ন পুঁথির অনুলিপি এবং অনুলিপির অনুলিপি করে তৈরি করলেন পাহাড়প্রমাণ পুঁথি এসব দেখেই প্রশংসাবাক্যটি উচ্চারিত হয়েছিল।  

সরলার্থ : 

তোতাপাখীটিকে যথার্থভাবে শিক্ষিত করতে প্রয়োজন প্রভূত পুঁথির , কারণ যত বেশি পুঁথি পড়বে পাখি, তত বেশি শিক্ষিত হবে সে।  পন্ডিতের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দর্শনার্থীরা একমত ছিলেন বলে পাখির শিক্ষায় বরাদ্দ পুঁথির পরিমাণ দেখে তাঁরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।  

তাৎপর্য : 

ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিশুশিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পাঠ্যপুস্তকের আধিক্য।  সাধারণ মানুষও মনে করতেন যে শিক্ষার্থীরা যত বেশি সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পড়বে , তারা ততই বিদ্বান হবে।  তাঁরা ভাবেন নি যে, পাঠ্যপুস্তকের প্রবল চাপে  শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনার বিকাশই রুদ্ধ হয় না, তার স্বকীয়তাও বিনষ্ট হয়।  




পোস্টমাস্টার

প্রশ্ন ও উত্তর    (১) ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ?  উত্তরঃ  ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি 'হিতবাদী' পত...