আবার আসিব ফিরে
জীবনানন্দ দাশ
আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে - এই বাংলায়
হয়তো মানুষ নয় - হয়তো -বা শঙ্খচিল শালিকের বেশে ,
হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে -
কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায় ;
হয়তো বা হাঁস হব - কিশোরীর ঘুঙুর রহিবে লাল পায় ,
সারাদিন কেটে যাবে কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে ভেসে ;
আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত্রে ভালোবেসে
জলাঙ্গি ঢেউয়ে ভেজা বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায়।
হয়তো দেখিবে চেয়ে সুদর্শন উড়িতেছে সন্ধ্যার বাতাসে ;
হয়তো শুনিবে এক লক্ষ্মীপ্যাঁচা ডাকিতেছে শিমুলের ডালে ;
হয়তো খইয়ের ধান ছড়াইতেছে শিশু এক উঠোনের ঘাসে
রূপসার ঘোলা জলে হয়তো কিশোর এক সাদাছেঁড়া -পালে
ডিঙা বায় , রাঙা মেঘ সাঁতরায়ে অন্ধকার আসিতেছে নীড়ে ,
দেখিবে ধবল বক : আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে।
বিষয় সংক্ষেপ :
রবীন্দ্রোত্তর কাব্যধারার অন্যতম পথপ্রদর্শক জীবনানন্দ দাশ(১৮৯৯-১৯৫৪)। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতাকে বলেছেন 'চিত্ররূপময়'। " আবার আসিব ফিরে " কবিতা টি একটি সনেট জাতীয় কবিতা। এটি "রূপসী বাংলা " কাব্য গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
'আবার আসিব ফিরে ' কবিতাটিতে কবির প্রকৃতি প্রেম , গ্রামবাংলার প্রতি কবির ভালোবাসা ও গভীর আকর্ষণ প্রকাশ পেয়েছে।
গ্রাম বাংলার প্রকৃতি , ইতিহাস ও সৌন্দর্য জীবনানন্দের কবিমানসের যে অনুভূতির সঞ্চার করেছে। তারই কাব্যিক রূপায়ণ হল এই কবিতা। পল্লিবাংলার পরিবেশ এবং তার সৌন্দর্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে এখানে। বাংলার পল্লি -প্রকৃতিকে তিনি এত ভালোবেসেছিলেন যে, মৃত্যুর পরও যদি কোনো জন্মান্তর থাকে তবে কবির এই আকাঙ্ক্ষা কবিতাকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। কবি বলেছেন , তিনি পুনরায় এই পল্লি বাংলার ধানসিড়ি নদীর তীরে জন্ম নিতে চান। মানুষ রূপে জন্মগ্রহণ করতে না পারলেও কবির কোনো দুঃখ থাকবে না। শঙ্খচিল কিংবা শালিখ অথবা ভোরের কাক হয়ে কার্তিক মাসের সকালে কুয়াশা ভেজা নবান্নের দেশে কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা শান্ত বাংলায় ভেসে বেড়াতে চান কবি। হয়তো হাঁস হয়ে তিনি বিচরণ করবেন কলমীর গন্ধভরা পুকুরের শান্ত নিস্তরঙ্গ জলে , গ্রাম্য কিশোরীর পায়ের ঘুঙুরের মতো কলমীর লতা জড়ানো থাকবে তার লাল পায়ে। বাংলার নদী , মাঠ , ক্ষেত কবির ভালোবাসার স্থান। তিনি আবার এখানে ফিরে আসতে চান জলঙ্গি নদীর ঢেউয়ে ভেসে সবুজ প্রকৃতির কোলে।
বাংলার আকাশে উড্ডীন সুদর্শন পাখির মতো সন্ধ্যার বাতাসে মিশে থাকতে পারেন কবি। হয়তো শিমুল গাছের ডালে বসে ডাকছে যে লক্ষ্মীপেঁচা তার অস্তিত্বের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে কবিকে। উঠানের ঘাসে খই ছড়াচ্ছে যে শিশু বা রূপসা নদীর ঘোলাজলে সাদা পাল ছেঁড়া ডিঙা ভাসাচ্ছে যে কিশোর তার মধ্য দিয়েই কবি ফিরবেন পল্লি বাংলায়। কবি বলেছেন যে , সাদা বকেরা রাঙা মেঘের মধ্য দিয়ে সাঁতার দিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে পড়ন্ত সন্ধ্যায় যখন বাসায় ফেরে তাদেরই ভিড়ে মিশে থাকবেন কবি হয়তো তাদেরই একজন হয়ে। এই ভাবেই প্রকৃতির গভীরতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে মৃত্যুর পর পুনরায় এ বাংলার পল্লীজীবনে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন কবি নানা রূপে , নানা ভাবে।
প্রশ্নোত্তর :
(১) " আবার আসিব ফিরে " কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে ?
উত্তর : " রূপসী বাংলা " কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
(২) " আবার আসিব ফিরে " কী জাতীয় কবিতা ?
উত্তর : সনেট বা চতুর্দশপদী কবিতা।
(৩) কবি কোথায় ফিরে আসতে চান ?
উত্তর : কবি এই বাংলায় ধানসিড়িটির তীরে ফিরে আসতে চান।
(৪) তিনি কোন কোন রূপে ফিরে আসতে চেয়েছেন ?
উত্তরঃ কবি আগামী জন্মে শালিখ , শঙ্খচিল , হাঁস ইত্যাদি রূপে ফিরে আসতে চেয়েছেন।
(৫) কবির ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা কেন ?
উত্তরঃ বাংলার মাটির সঙ্গে কবির চেতনা এমন গভীর ভাবে অন্বিত যে মৃত্যুর মাধ্যমে বাংলা থেকে বিচ্ছেদ তিনি সহ্য করতে পারে না। তাই তাঁর অন্তরে সুতীব্র বাসনা জাগ্রত হয়েছে।
(৬) " সবুজ করুণ ডাঙায় " কথাটির অর্থ কী ?
উত্তরঃ কবি বাংলার শ্যামলভূমিকে সবুজ ডাঙা বলেছে। " করুণ " বলার মধ্যে নিহিত আছে এই ভূমি থেকে বিচ্ছেদজনিত বেদনার অনুভূতি।
(৭) "সুদর্শন " কথাটির অর্থ কী ? কোন প্রসঙ্গে এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে ?
উত্তরঃ " সুদর্শন " কথাটির অর্থ চিল।
বাংলার সন্ধ্যার আকাশে চিলের চক্রাকারে আকাশ পরিভ্রমণ অতি স্বাভাবিক দৃশ্য। এই প্রসঙ্গে " সুদর্শন " শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
(৮) " খইয়ের ধান " কথাটির অর্থ লেখ।
উত্তরঃ খই ভাজার পর ধানের বহিরাবরণ ছড়িয়ে রাখা হয়। শিশুরা সেগুলি নিয়ে খেলা করে। সেই চিত্র ফুটিয়ে তোলার জন্য " খইয়ের ধান " বলা হয়েছে।
(৯) " আমারেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে "
---- কাকে কাদের ভিড়ে পাওয়া যাবে বলা হয়েছে ?
উত্তর : কবি বাংলার দৃশ্য সম্পদকে এমনই ভালবাসেন যে , মৃত্যুর পর নিজেকে সেই সব দৃশ্যের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন রূপে অন্বিত( যুক্ত ) হতে চেয়েছেন। সন্ধ্যার আকাশের চিল, শিমূলের ডালে বসা লক্ষ্মীপেঁচা , উঠোনের ঘাসে খই -এর ধান ছড়ানো শিশু , সাদা ছেঁড়া পলে ডিঙা বেয়ে চলা কিশোর , অন্ধকারে ঘরে ফেরা ধবল বক ইত্যাদির মধ্যে কবি নিজের অস্তিত্ব অন্বিত করে বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন।
(১০) " আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে-- এই বাংলায় হয়তো মানুষ নয় ................."
(ক) কবির এইরূপ ইচ্ছার কারণ কী ?
(খ) কবি কীসে বিশ্বাসী ?
(গ) তিনি কীভাবে এই বাংলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন ?
উত্তরঃ
(ক) কবির এই রূপ ইচ্ছার কারণ বাংলার প্রতি তাঁর গভীর ভালোবাসা। কবি বাংলার নদী , মাঠ , ঘাটকে ভালোবেসে ফিরে আসতে চান এই বাংলায়।
(খ) কবি জন্মান্তরে বিশ্বাসী। তাঁর বিশ্বাস এ জন্মে নয় পরের
জন্মেও কবি এই বাংলায় ফিরে আসবেন। মানুষ হয়ে না এলেও হয়তো অন্য কোনো প্রাণী যেমন -শঙ্খচিল , শালিখ, কাক , হাঁস অথবা অন্য কিছুর রূপ নিয়ে এই বাংলাতেই জন্মগ্রহণ করবেন।
(গ) কবি বারবার ফিরে আসতে চেয়েছেন এই বাংলায় হয়তো শঙ্খচিল অথবা শালিখের বেশে। হয়তো ভোরের কাক হয়ে কুয়াশার বুকে ভেসে ভেসে আসতে চান - কাঁঠাল ছায়ায় কার্তিকের নবান্নের দেশে কিংবা হাঁস হয়ে আসতে চান -কলমির গন্ধ ভরা জলে ভেসে তার সারাদিন কেটে যাবে। নদী -মাঠ -ঘাট ভালোবেসে কবি আবার আসতে চান জলঙ্গীর জলে ভেজা এই বাংলার সবুজ করুণ পেলব ডাঙায় ফিরে আসতে চান।
(১১) " এক সাদা ছেঁড়া পালে ডিঙা বায় "
(ক) কে ডিঙা বায় ? কোথায় ডিঙা বায় ?
(খ) কীভাবে ডিঙা বায় ?
(গ) কবির ঐকান্তিক ইচ্ছা কী ?
উত্তরঃ
(ক) কবি জীবনানন্দ দাশ রচিত " আবার আসিব ফিরে " কবিতায় কবি বর্ণনা করেছেন এক কিশোর রূপসা নদীর ঘোলা জলে ডিঙা বায়।
(খ) কিশোরটি রূপসার ঘোলা জলে ছেঁড়া পাল ডিঙাটি বেয়ে চলেছে। অস্তমিত সূর্যের রক্তিম বর্ণে পশ্চিম আকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। স্তরে স্তরে সঞ্চিত রক্তিম মেঘগুলিকে সাঁতরে অন্ধকার অতিক্রম করে নীড়ে ফিরে আসছে যে সাদা বক , কবির মনে হচ্ছে কিশোরটিও সাদা ছেঁড়া পাল নিয়ে তার নীড়ে ফিরে আসছে।
(গ) কবির ঐকান্তিক ইচ্ছা কবিও জন্মান্তরে ওই কিশোরটির মতো কিংবা স্তরে স্তরে সজ্জিত রক্তিম বর্ণের মেঘের সমুদ্র পার হয়ে ওই সাদা বকটির মতো উড়ে আসবেন এই বাংলায়। কবি জন্মান্তরে বাংলাকে ভালোবেসে বার বার ফিরে আসতে চান এই বাংলায়।
(১২) আমাকেই পাবে তুমি ইহাদের ভিড়ে "
(ক) প্রসঙ্গ কী ?
(খ) 'ইহাদের ভিড়ে ' বলতে কী বোঝ ?
উত্তরঃ
(ক) কবি জীবনানন্দ দাশ " আবার আসিব ফিরে " কবিতায় বলেছেন তিনি জন্মান্তরে বিশ্বাসী। তিনি আবার ফিরে আসবেন এই বাংলায় তাঁর জন্মভূমিতে। কিন্তু কী রূপে আসবেন তা তিনি জানেন না। এই প্রসঙ্গেই কবি প্রশ্নে উল্লিখিত উক্তিটি করেছেন।
(খ) কবির বিশ্বাস তিনি মানুষ হয়ে না ফিরতে পারলেও কোনো ক্ষতি নেই। ওই যে শঙ্খচিল , শালিক , হাঁস কিংবা লক্ষ্মীপেঁচা যাদের ডাক প্রতিনিয়ত শোনা যায় বাংলার বুকে -তাদের কারও একজনের রূপ ধরে ফিরে আসবেন গ্রাম বাংলার কোন এক কাঁঠাল গাছের ছায়ায় , কিংবা কোন কিশোরীর হাঁস হয়ে অথবা যে সাদা বকটি রাঙা মেঘ সাঁতরিয়ে নিজের নীড়ে ফিরে আসছে তাদের সবার মাঝখানে কবিকে খুঁজে পাওয়া যাবে বলে কবি মনে করেছেন।