Showing posts with label class X ICSE. Show all posts
Showing posts with label class X ICSE. Show all posts

Wednesday, 21 June 2023

 বাবু বলেন 

শঙ্খ ঘোষ 


উৎস : 

'বাবু বলেন ' কবিতাটি কবির 'বাবরের প্রার্থনা ' থেকে নেওয়া। 

 ( ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দে 'বাবরের প্রার্থনা ' কাব্যের জন্য তিনি সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন। ) 


মূল বিষয়বস্তু :

অষ্টাদশ -ঊনবিংশ শতকের বাবু সম্প্রদায়ের উত্তর পুরুষ এ যুগের বাবুদের সম্পর্কে কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'বাবু বলেন ' কবিতায় বলেছেন।  সমাজে যুগে যুগে বাবুত্বের ধারণা বদলে গেছে।  ইংরেজ রাজত্বের আগে 'বাবু' কোন বিশেষ অর্থ বহন করে না।  ইংরেজ যুগে ব্রিটিশ সরকারের উপাধি 'বাবু' আবার ধনী , বিলাসী , অকর্মন্যরাও 'বাবু '। যুগে যুগে 'বাবু' বলতে আমরা বুঝি সমাজের গণ্যমান্য সম্প্রদায় সে তারা অর্থ কৌলিন্যে হোক , জাত  কৌলিন্যে বা বিদ্যা-বুদ্ধির কৌলিন্যে।  ঊনবিংশ শতাব্দীর 'বাবু' সম্প্রদায় আর নেই কিন্তু নতুন যুগে যে নতুন 'বাবু' শ্রেণির উদ্ভব হয়েছে তার বর্ণনাই কবি দিয়েছেন।  

                      পূর্ববর্তী বাবুদের মতো এ যুগের বাবুরাও নিষ্কর্মা এবং পুঁথিগত বিদ্যার দ্বারা তাদের জ্ঞান সীমিত।  কর্মব্যবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করতে চায় না এই বাবুরা।  তাদের কেবল বাক্চাতুর্য্য আর বিদ্যা জাহির করার আস্ফালন।  তারা মনে করে কর্মীর জীবনযাপন করবে তাদের চাকর-বাকরেরা।  তাই তারা বলে- 

" আমি কেবল কথাই বলে 

পুঁথিই পড়ি বসে 

জীবনযাপন ? করুক সেটা 

চাকরবাকরেরা। " 


চাকরবাকরেরা অর্থাৎ যারা শ্রম বিক্রি করে বাবুদের কাছে।  বাবুরা নিয়ন্ত্রণ করে চাকরবাকরদের জীবন।  বাবুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবনে মৃত্যু ঘটলে সেই মৃত্যুর ডে নিতে অস্বীকার করে বাবুরা। অহংকারী বাবুর দল মনে করে বিদ্যাবুদ্ধির জেরে তারাই সকলের সেরা।  তাই তাদের মতে যে যেখানে মারা যাচ্ছে , তারা তাদের নির্বুদ্ধিতার জন্যই মারা যাচ্ছে।

" মরছে যারা মরুক তারা 

নিজের নিজের দোষে 

আমি জানি, মাথার জোরে 

আমিই সবার সেরা। "

তথাকথিত দাম্ভিক এই বাবুর দল বলে , 

" মানুষ ছুঁতে চাই না বটে ,

মানবতার জ্ঞানে " 

দম্ভের চূড়ায় বসে তাদের থেকে যে শ্রমজীবি মানুষরা আছে তাদের মানুষ  বলে মনে করে না।  তাই মানবিকতার আঙ্গিক থেকে তাদের ছুঁতে চায় না , বুঝতে বা তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না।  যে মানুষ অপর একজন মানুষকে মানবতার জ্ঞানে  বা মানবিকভাবে ছুঁতে চায় না তার না ছোঁয়ায় মঙ্গল কারণ সে নিজেই মানুষ হয়ে উঠতে পারে নি।  মানুষ হয়ে উঠতে না পারার কারণ 

" হৃদয়মেধা থাকে আমার 

সব সময়ে ঘেরা "

হৃদয় বা মেধা সবসময় ঘেরা থাকলে তার বিকাশ লাভ সম্ভব নয়। মিথ্যে অন্তঃসারশূন্য বাক্যের আস্ফালন দিয়ে তারা পৃথিবীকে পাল্টে দিতে চায়।  পৃথিবীকে চালিত করতে চায়।  তারা তাদের মিথ্যে তৈরি ভুবনে নিজেদের ভুলিয়ে রাখেন। অপরদিকে শ্রমজীবি মানুষের দল 'জীবনযাপন ' করে চলে।  

           কবিতার শেষে কবি বলেন বাবুদের এই অন্তঃসারশূন্যতা সবাই বুঝতে পারবে।  তারা যে 'মিথ্যে এবং মেকি', সবার কাছে তা ধরা পরে যাবে।  ফলে তাদের মিথ্যের 'আখ্যানে-ব্যাখ্যানে ' দিয়ে তৈরি 'ডেরা ' পুড়ে যায়।  তখন সেই মিথ্যের ডেরায় পুড়তে পুড়তে জানালা দিয়ে দেখতে পায় তাদের যে চাকর বাকরেরা আছে তারা নিজেদের মত করে জীবনকে যাপন করে চলেছে অর্থাৎ জীবন কাটিয়ে চলেছে। 



Thursday, 8 June 2023

বাংলায় গুরুদেবের তাৎপর্য ও 'গিন্নি' , 'লালু' , 
' বামা' গল্পে গুরুদেবের প্রসঙ্গ 

বাঙালি ধর্মভীরু জাতি।  বিশ্ব সংসারের সবকিছুকেই সে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে।  শিক্ষা , সংসারের সমৃদ্ধি বা নিজের প্রাণ সবকিছুকেই সে ঈশ্বরের দান মনে করে।  আর এই ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে সে 'গুরু'কে  নিজের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে। কখনো সে শিক্ষাগুরু আবার কখনো সে ধর্মগুরু।  'শিক্ষাগুরু'র বিভিন্নরূপ আমরা বাংলা সাহিত্যে অনেক পাই।  যেমন রবীন্দ্রনাথের 'মাস্টারমশাই ', 'অচলায়তন ','গিন্নি' ; বনফুলের 'যোগেন পন্ডিত' , নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দাম' গল্পে।  ধর্মগুরুর বিভিন্ন রূপ দেখতে পাই শরৎচন্দ্রের    'লালু ' , পরশুরামের ' বিরিঞ্চিবাবা' গল্পে। 
                                রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'গিন্নি' গল্পে 'শিক্ষাগুরু'র উল্লেখ আমরা গল্পের প্রথমেই দেখতে পাই।  গল্পকথক আমাদের জানান তার স্কুলে ছাত্রবৃত্তি ক্লাশের দুই তিন শ্রেণি নীচে তাদের শিক্ষক ছিলেন শিবনাথ পন্ডিত।  শিবনাথ পন্ডিতের চেহারা বা ছাত্রদের প্রতি তাঁর ব্যবহারের যে বর্ণনা গল্পকথক দিয়েছেন তার কোনটাই তেমন সুখবর নয় , বিশেষভাবে ছাত্রদের তিনি যেভাবে শাসন করতেন।  কথায় আছে " শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। " শিবনাথ পন্ডিতের চরিত্রে ছাত্রদের প্রতি স্নেহের প্রকাশ কখনোই দেখা যায় না।  গল্পকথক বলেছেন  শিবনাথ পন্ডিতের "কিল চড়চাপড়  চারাগাছের বাগানের উপর শিলাবৃষ্টির মতো " যেমন অজস্র বর্ষিত হাত তেমনই তাঁর 'তীব্র বাক্যজ্বালায় ' প্রাণ বের হয়ে যেত।  ছাত্রদের কষ্ট দেওয়ার আর একটি নতুন ও অভিনব অস্ত্র তাঁর ছিল।  তিনি ছাত্রদের চেহারা বা কিছু কাজ অনুযায়ী তাদের অত্যন্ত অপমানজনক নামকরণ করতেন।  তার ফলে ছাত্রটি সবার কাছে অত্যন্ত ব্যঙ্গের শিকার হত।  যেমন হয়েছিল আশু।  সে নিতান্ত বেচারা ভালোমানুষ ও লাজুক ছাত্র ছিল।  সে তার ব্যক্তিগত জীবন সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করত।  কিন্তু শিবনাথ পন্ডিত একদিন ঘটনাক্রমে জানতে পারেন যে আশু তার ছোটবোনের সঙ্গে                 ' পুতুলের বিয়ে ' খেলছিল।  ছোটবোনের একদিনের সেই নিরীহ খেলার জন্য আশুকে তিনি নামকরণ করেন 'গিন্নি' কারণ তাঁর কাছে 'পুতুলের বিয়ে' খেলা 'মেয়েলি' ও 'হাস্যকর '। তিনি একবার ও ভাবলেন না এই নামকরণের ফলে একটি ছোটছেলের মন কতখানি আহত ও বিপর্যস্ত হল। 'শিক্ষাগুরু'  হিসেবে শিবনাথ পন্ডিত আমাদের কাছে শ্রদ্ধার আসন বিচ্যুত হলেন। 
                           শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'লালু' গল্পে আমরা যে  গুরুদেবের  সাক্ষাৎ পাই।  তিনি যদিও সংসার ত্যাগ করে ভগবানের সাধনা করার জন্য আশ্রমে থাকেন তবুও তিনি যখন শিষ্যার বাড়িতে আসেন তখন তাঁর জাগতিক সুখ ভোগের দিকেই বেশি লক্ষ্য থাকে।  গুরুদেব একজন অত্যন্ত সাধারণ ও আরামপ্রিয় মানুষ।  কিন্তু লালুর মা অন্ধভক্তি দ্বারা তাকে দেবত্বে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন।  লালু দুষ্টুমি করে গুরুদেব ও মাকে  জব্দ করতে চেয়েছিল কিন্তু গুরুদেবের রাতভোর যে দুর্ভোগ হয় তার মাধ্যমে লেখক হয়তো বলতে চেয়েছেন অন্ধভক্তি যখন মানুষের বোধবুদ্ধিকে ভোঁতা করে দেয় তখন মানুষের জীবনেও নেমে আসে দুর্ভোগ।  
                             বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'বামা' গল্পে আমরা আবার আর এক 'ঠাকুরমশাই' এর সাক্ষাৎ পাই।  তিনি নিজে দৈব মাদুলি ও ঔষধ বিক্রয় করেন কিন্তু নিজের বিপদের সময় দৈবে ঠিক ভরসা রাখতে পারেন না।  বরং এক বুদ্ধিমতী গৃহবধূর উপস্থিত বুদ্ধিতে বিপদ থেকে উদ্ধার পান।  ঠাকুরমশাই তাঁর  জীবনদাত্রী গৃহবধূ বামাকে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। 












Saturday, 28 January 2023

রবীন্দ্রনাথের প্রতি - বুদ্ধদেব বসু

 তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে 

হে বন্ধু, হে প্রিয়তম।  সভ্যতার শ্মশান-শয্যায় 

সংক্ৰমিত মহামারী মানুষের মর্মে ও মজ্জায় ; 

প্রাণলক্ষ্মী নির্বাসিতা।  রক্তপায়ী উদ্ধত সঙিনে 

সুন্দরেরে বিদ্ধ ক'রে , মৃত্যুবহ পুষ্পকে উড্ডীন 

বর্বর রাক্ষস হাঁকে , ' আমি শ্রেষ্ঠ , সবচেয়ে বড়ো। '

দেশে -দেশে সমুদ্রের তীরে তীরে কাঁপে থরোথরো 

উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ। 

প্রাণ রুদ্ধ, প্রাণ স্তব্ধ।  ভারতের স্নিগ্ধ উপকূলে 

লুব্ধতার লালা ঝরে।  এত দুঃখ , এ দুঃসহ ঘৃণা -

এ-নরক সহিতে কি পারিতাম , হে বন্ধু , যদি না 

লিপ্ত হ'তো রক্তে মোর , বিদ্ধ হ'তো গূঢ় মর্মমূলে 

তোমার অক্ষয় মন্ত্র।  অন্তরে লভেছি তবে বাণী 

তাই তো মানি না ভয় , জীবনেরই জয় হবে , জানি। 

উৎস : 

" ২২ শে শ্রাবণ " কাব্যগ্রন্থ।  (রবীন্দ্রনাথের ' সভ্যতার সংকট ' থেকে প্রেরণা )। 

শব্দার্থ : 

স্মরণ - মনে করা 

দুর্দিন -খারাপ দিন বা খারাপ সময় 

প্রিয়তম - সর্বাপেক্ষা প্রিয় 

শয্যা -বিছানা 

শ্মশান শয্যা - মৃত্যুর বিছানা 

মর্মে - অন্তরে বা মনে 

মহামারী - মড়ক (সংক্ৰমণ রোগে ব্যাপক মৃত্যু ) 

মজ্জা - শরীরের ভিতর হাড়ের মধ্যের স্নেহ জাতীয় যে পদার্থ                   থাকে 

নির্বাসিতা - নির্বাসন দেওয়া বা গৃহ থেকে বহিষ্কার করা 

রক্তপায়ী - যে রক্ত পান করে 

উদ্ধত - গর্বিত 

উড্ডীন - উড়ন্ত 

উন্মত্ত - ক্ষিপ্ত বা উত্তেজিত 

রুদ্ধ - বন্ধ বা আটক 

স্তব্ধ - থেমে  যাওয়া 

স্নিগ্ধ - শান্ত 

লুব্ধতা -লোভ 

ঘৃণা - ঘেন্না করা 

গূঢ় - নিভৃত 

অক্ষয় - ক্ষয়হীন  বা চিরস্থায়ী 

লিপ্ত - মিশে যাওয়া 

বিদ্ধ - গেঁথে দেওয়া 

সঙিন - বন্দুকের মুখ সংলগ্ন বেধনাস্ত্র বিশেষ , বেয়নেট 


বিষয় সংক্ষেপ :  

আধুনিক বাংলা কাব্য-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বুদ্ধদেব বসু।  রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের বছর লেখা হয় ' রবীন্দ্রনাথের প্রতি'। 

        দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে বিশ্বব্যাপী যে অনিশ্চয়তা তাঁর আঁচে প্রতিটি বিবেকী মানুষ দগ্ধ হয়েছে।  মন হয়েছে অস্থির। এই চঞ্চলতার মুহূর্তে কবি স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে ,--

" তোমাকে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে 

হে বন্ধু , হে প্রিয়তম। "

শুধু স্মরণ নয় , তাঁকে 'বন্ধু' এবং 'প্রিয়তম' রূপে সম্বোধনে বোঝা যায় কবির অন্তরের কতখানি জায়গা জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বযুদ্ধ বহু মানুষকে শুইয়েছে শেষ শয্যায় , মন্বন্তর ,মহামারী মানুষের অন্তরকেও দিয়েছে একেবারে নিঃস্ব করে। এই সর্ব নিঃস্বতার পরিবেশে সুন্দরের কোনও স্থান নেই।  সে প্রতি মুহূর্তে বিদ্ধ হচ্ছে রক্তপায়ী মানুষজনের উদ্যত সঙ্গিনে। যে আকাশ ছিল মুক্তির প্রতীক, যেখানে রামায়ণের কালে শ্রীরামচন্দ্রের বাহন পুষ্পক বিহার করত জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে সেই আকাশ এখন দখল করেছে মৃত্যুবাহী যুদ্ধবিমান।  কবি আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন সেই মৃত্যুদূত স্বরূপ সর্বগ্রাসী রাক্ষসদের তান্ডবে।  তারা প্রমাণ করতে চায় তারা সবচেয়ে বড় - 'আমি শ্রেষ্ঠ , সবচেয়ে বড়ো'। 

তাদের দাপটে --

" দেশে দেশে সমুদ্রের তীরে তীরে কাঁপে থরো থরো 

উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ। "

লক্ষণীয় সে সময় জাপানী আক্রমণ অত্যন্ত তীব্র হয়েছে। হিটলার অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে চরম সিদ্ধির লক্ষ্যে - ফলে সাধারণ মানুষের অবস্থা হয়েছে উন্মত্ত জন্তুর মুখে হরিণের মতো অসহায়।  

যে ভারতবর্ষ এককালে সারা পৃথিবীতে সন্ধান দিয়েছে মৃত্যুজয়ী অমৃতের সেই ভারতবর্ষ শক্তিমানের নিষ্ঠুরতায় , শোষকের শোষণে ও রক্তচক্ষু প্রদর্শনে প্রাণের প্রবাহ গিয়েছে রুদ্ধ হয়ে , জীবন হয়ে উঠেছে বিষময় , প্রাণ রুদ্ধ , এর কারণ শোষকের শোষণ বাসনা অতি তীব্র।  দীর্ঘকাল ধরে চলেছে এই শোষণ।  কিন্তু বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ও শোষণের ভয়াবহ রূপ দেখে ব্যথিত হয়ে উঠেছেন কবি।  তাই কবি বলেছেন -----

' এত দুঃখ , এ দুঃসহ ঘৃণা -----

এ নরক সহিতে কি পারিতাম , হে বন্ধু যদি না 

লিপ্ত হ'তো রক্তে মোর , বিদ্ধ হ'তো  গৃঢ় মর্মমূলে 

তোমার অক্ষয় মন্ত্র। "

কবি বুঝেছেন তাঁর এই সহ্যশক্তির মূলে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের অমোঘমন্ত্র।  তাঁর পরিবেশিত জীবনের অমৃতশক্তি, আনন্দবাদী রবীন্দ্রনাথ সংশয়ী  কবি বুদ্ধদেবের মনে জায়গা করে নিয়েছেন এই সর্বনষ্ট জগতের বুকে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করেন নি কবি।  তিনি জানেন শেষ পর্যন্ত "জীবনের জয় হবে" । এই অস্তি চেতনা , এই আনন্দবাদী অনুভব  কবি বুদ্ধদেবকে কবি রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি এনেছে। 









Thursday, 28 January 2021

বঙ্গভূমির প্রতি

 বঙ্গভূমির প্রতি 

মাইকেল মধুসূদন দত্ত 

রেখো,  মা , দাসেরে মনে , এ মিনতি করি পদে। 

           সাধিতে মনের সাধ 

           ঘটে যদি পরমাদ ,

মধুহীন করো না গো             তব  মনঃকোকনদে। 

প্রবাসে , দৈবের বশে , 

জীব-তারা যদি খসে 

এ দেহ-আকাশ হতে ,       নাহি খেদ তাহে।  

জন্মিলে মরিতে হবে ,

অমর  কে কোথা  কবে , 

চিরস্থির কবে নীর ,                     হায় রে জীবন-নদে ? 

কিন্তু যদি রাখ মনে ,

নাহি , মা, ডরি শমনে ;

মক্ষিকাও  গলে না গো                      পড়িলে অমৃত-হ্রদে।  

সেই ধন্য নরকুলে , 

লোকে যারে নাহি ভুলে , 

মনের মন্দিরে সদা                                       সেবে সর্বজন। 

কিন্তু কোন গুণ আছে ,

যাচিব যে তব কাছে , 

  হেন অমরতা আমি ,                       কহ , গো, শ্যামা জন্মদে ! 

তবে যদি দয়া কর ,

ভুল দোষ , গুণ ধর ,

অমর করিয়া বর      দেহ  দাসে , সুবরদে  ! 

ফুটি যেন স্মৃতি-জলে ,

মানসে , মা, যথা ফলে 

মধুময় তামরস ,                  কি বসন্ত কি শরদে ! 


 সার -সংক্ষেপ : 

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'বঙ্গভূমির প্রতি ' কবিতায় বঙ্গজননীর প্রতি তাঁর বিনীত মিনতি জ্ঞাপন করেছিলেন।  তিনি বলেছেন যে বঙ্গজননী যেন কবিকে চিরকাল মানুষের স্মৃতিতে অমলিন রাখেন।  উচ্চভিলাষী কবি বিদেশ যাওয়ার আগে মাতৃভূমির কাছে এই প্রার্থনা জানিয়েছেন যে তিনি যেন কবিকে সর্বদা মনে রাখেন।  মানুষের দেহ নশ্বর , কিন্তু স্মৃতি অবিনশ্বর।  নশ্বর এই দেহের বিনাশ ঘটলেও নিজের কীর্তির মধ্যে দিয়ে মানুষ অন্য মানুষের মনে অমরত্ব পেতে পারে।  

         কবি নিজেই বললেন যে , জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু অনিবার্য।  নদীতে জল যেমন স্থির নয় , চির প্রবাহমান , তেমন মানুষের জীবনও স্থির নয়।  মানব জীবনের ধর্ম চিরপ্রবাহমানতা।  কিন্তু কবির বিশ্বাস তিনি কর্মের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে স্থান করে নিতে পারবেন।  তাই তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না।  তিনি মানুষের মনের মন্দিরে চির ভাস্বর থাকতে চান।  ক্ষুদ্রতম মক্ষিকাও যেমন অমৃত হ্রদে পড়লে মরে না , অমৃতের স্পর্শে সে যেন অমরত্ব লাভ করে, তেমনি বঙ্গ জননীর স্নেহ লাভ করতে পারলেই কবিও ধন্য হবেন।  

       কবি বঙ্গমাতার স্নেহের উপর একান্ত নির্ভর করে বলেছেন যে , তাঁর এমন কোন গুণ নেই যে , তিনি বঙ্গভূমির কাছে অমরত্ব প্রার্থনা করতে পারেন , তবে বঙ্গজননী যদি কৃপা করে তাঁর দোষ ত্রূটিকেই গুণ বলে ধরেন  এবং তাঁকে অমরত্বের বর দান করেন , তবে এই সুবরদায়িনী বঙ্গমাতার কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।  

        কবিতার শেষ স্তবকে কবি এই অমরত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।  গৌড়জনের জন্য তিনি এমন কাব্য রচনা করে যেতে চান যা চিরকালের আনন্দ সুধা বর্ষণ করবে।  বঙ্গবাসীর হৃদয়মন্দিরে বিরাজ করে তিনি তাঁদের স্মৃতিতে চির অক্ষয় হয়ে বিরাজ করতে চান, যেমন তিব্বতের মানস সরোবরে সব ঋতুতে পদ্মফুল ফুটে থাকে।  এইভাবে কবি বঙ্গবাসীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল থেকে অমর হয়ে থাকতে চান।       


শব্দার্থ :

দাসেরে - সেবক কে 

মিনতি -- প্রার্থনা 

সাধিতে - সম্পাদন করতে 

সাধ- ইচ্ছা 

পরমাদ - ভুল 

প্রবাসে - বিদেশে 

কোকোনদ - লালপদ্ম 

দৈবের বশে - নিয়তি বা দৈবশক্তির প্রভাবে 

দেহ - আকাশ -- দেহরূপ আকাশ 

খেদ - দুঃখ , অনুশোচনা 

নরকুলে- মানব সমাজে 

নিত্য - সর্বদা 

সেবে- সেবা করে 

মাগিব - প্রার্থনা করিব 

হেন- এইরূপ 

শ্যামা - শ্যামলা বঙ্গভূমি 

জন্মদে - জন্ম দেন যিনি 

মানসে -- মানস সরোবরে 

তামরস - পদ্মফুল 


  



প্রশ্ন ও উত্তর 

(১)                                          " প্রবাসে , দৈবের বশে , 

জীব-তারা যদি খসে 

এ দেহ-আকাশ হতে ,       নাহি খেদ তাহে। "

(ক) ' প্রবাসে ' বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? 

(খ)  কবি উল্লিখিত উক্তিটির মধ্যে দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন ? 

(গ) কবির খেদ নেই কেন ? 

(ঘ) তিনি কী কামনা করেছেন ? 

উত্তর : 

(ক) ' প্রবাসে ' শব্দটির অর্থ বিদেশে।  কবি মধুসূদন দত্ত ১৮৬২ সালের ৯ই জুন ইউরোপ যাত্রা করেন।  তাঁর অন্যতম বন্ধু গৌরদাস বসাককে 'ইউরোপ যাত্রার পূর্বে একটি পত্র লেখেন ৪ ই জুন।  সেই পত্রের সঙ্গেই 'বঙ্গভূমির প্রতি ' কবিতাটি তিনি পাঠিয়েছিলেন বন্ধু গৌরদাস বসাককে।

(খ) কবি বলেছেন বিদেশে গিয়ে নিয়তির কবলে পড়ে কোনো দৈবদুর্বিপাকে পড়তে পারেন।  এবং তার ফলে আকাশ থেকে যেমন তারা খসে পড়ে সেইরূপ দেহ থেকে জীবন খসে পড়ে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।  কবি এখানে জীবনকে তারার সঙ্গে ও দেহকে আকাশের সঙ্গে তুলনা করেছেন।  

(গ) কবি বলেছেন বঙ্গজননী যদি তাঁর মনের মনিকোঠায় কবিকে স্থান দেন তবে প্রবাসে গিয়ে যদি তাঁর মৃত্যুও হয়ে যায় , তবু তিনি কোনো খেদ বা অনুশোচনা করবেন না।  

(ঘ) তিনি বঙ্গজননীর কাছে কামনা করেছেন , মা যেন তাঁকে মনে রাখেন।  মনের সাধ পূর্ন করতে গিয়ে যদি কোনো প্রমাদ বা ভুল হয়ে যায় তাঁর তবুও মনরূপ পদ্ম থেকে মধুসূদনকে ভিন্ন না করেন।  


(২)                                               "জন্মিলে মরিতে হবে ,

অমর  কে কোথা  কবে ,"

(ক) ' অমরত্ব ' বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? 

(খ) কবি এই চিরন্তন কথাটি দ্বারা কী বোঝাতে চেয়েছেন ? 

(গ) এই প্রসঙ্গে কবি কী তুলনা দিয়েছেন ? 

(ঘ) তিনি কী ধরনের অমরত্ব লাভ করতে চেয়েছেন ? 

উত্তরঃ

(ক) ' অমরত্ব' বলতে মৃত্যুহীনভাবে চিরকাল বেঁচে থাকাকে বোঝানো হয়েছে।  

(খ) কবি বোঝাতে চেয়েছেন মানুষ জন্মলাভ করলে তার মৃত্যু অনিবার্য।  জগতের কেউ কোথাও কখনও অমরত্ব লাভ করতে পারেনি।  

(গ) এই প্রসঙ্গে কবি বলেছেন , নদীর মধ্যে দিয়ে জলধারা যেমন বহমান , নদীর স্রোতধারা যেমন থেমে থাকে না , তেমনি জীবনও চিরপ্রবহমান।  জীবনের গতি কখনও শ্লথ হয় না।  নদীর জলধারা যেমন শেষপর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে সাগরে মেসে , জীবনও তেমনি নিঃশেষ হয়ে মৃত্যুর মধ্যে সমাহিত হয়।  এই চিরন্তন সত্যটিকে কবি এইভাবে উপমিত করেছেন।  

(ঘ) কবি জৈবিক অমরত্ব লাভ করতে চান না।  তিনি বঙ্গজননীর কাছে প্রার্থনা করেছেন যাতে তিনি সকল মানুষের মনে নিজ কীর্তির দ্বারা চির অম্লান হয়ে থাকতে পারেন।  মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকার মধ্যে দিয়ে তিনি অমরত্ব পেতে চান।  

(৩)                                     "কিন্তু কোন গুণ আছে ,

যাচিব যে তব কাছে , 

  হেন অমরতা আমি ,                       কহ , গো, শ্যামা জন্মদে ! "

(ক) ' শ্যামা জন্মদে ' বলতে কার কথা বোঝানো হয়েছে ? 

(খ) 'হেন অমরতা ' বলতে কোন শ্রেণির অমরতাকে বোঝানো হয়েছে ? 

(গ) কবি কী প্রার্থনা করেছেন ? 

(ঘ) কবি পরমুহূর্তেই নিজের জন্য কীভাবে প্রার্থনা পূরণের উপায়ের সন্ধান দিয়েছেন ? 

উত্তরঃ 

(ক)  'শ্যামা জন্মদে ' বলতে শস্যশালিনী জন্মদাত্রী বঙ্গমাতাকে বোঝানো হয়েছে।  

(খ) 'হেন অমরতা ' বলতে মানুষের সেই অমরতাকে বোঝানো হয়েছে যা তাকে মনুষ্যকুলে ধন্য করে।  মানুষ যেন কখনও তাঁকে বিস্মৃত না হয়।  মানুষের 'মনের মন্দিরে ' তিনি যেন দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত থেকে নিত্যদিন 'সেবা' পান।  এই অমরতা চির অক্ষয় আয়ু নয় , এই অমরতা চিরঅম্লান কীর্তির দ্বারা অর্জিত হয়।  

( গ) কবি প্রার্থনা করেছেন বঙ্গমাতা যেন তাঁর মন থেকে কবিকে সরিয়ে না দেন।  তাঁর কৃপা পেলে কবি সকলের মনে চির অক্ষয় হয়ে বিরাজ করবেন।  তাঁর হয়তো কোনো গুণই নেই তবু এই অমরতা তিনি প্রার্থনা করেন, যার দ্বারা কাব্যরসিকদের কাছে সাহিত্যিক হিসাবে তিনি অমর হয়ে থাকতে পারেন।  

(ঘ) কবি বলেন , তাঁর এমন কোন গুণ নেই যে বঙ্গমাতার কাছে এমন অমরতা তিনি প্রার্থনা করতে পারেন।  কিন্তু পরমুহূর্তেই বঙ্গমাতার অপার কৃপা লাভের প্রত্যাশী কবি বলেন , মা যদি তাঁর ভুল ত্রূটি মার্জনা করে শুধু গুণটুকু ধরেন , তবেই এই অমরত্ব আশীর্বাদের দ্বারা সুবরদায়িনী বঙ্গ জননী কবিকে ভরিয়ে তুলতে পারেন।  তার কাব্যপ্রতিভাকে গুণ রূপে বিবেচনা করে কবির প্রার্থনা মঞ্জুর   করা যায় ----- এই উপায়ের সন্ধান কবি দিয়েছেন।  

(৪) " ফুটি যেন স্মৃতি জলে ,

মানসে  মা যথা ফলে 

মধুময় তামরস কি বসন্তে , কি শরদে !" 

(ক) কার স্মৃতিতে ফুটে থাকতে চান কবি ? 

(খ) এই ইচ্ছা তিনি কার কাছে কামনা করেছেন ? 

(গ) "তামরস " বলতে কী বোঝানো হয়েছে ? 

(ঘ) উক্ত অংশের অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা কর।  

উত্তরঃ 

(ক) কবি মধুসূদন তাঁর মহান সাহিত্যকীর্তি দ্বারা মনুষ্যসমাজের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকতে চান চিরকালের জন্য।  তাঁর এ কামনা সর্বদেশের সর্বকালের কবি - সাহিত্যিকদেরই কামনা।  প্রত্যেক সাহিত্যিকের কামনা , মানুষের স্মৃতিতে সশ্রদ্ধ জাগরিত অস্তিত্ব।  যাতে তাঁদের  মৃত্যুর পরও আমরা মনে রাখি , তাঁদের কীর্তির জন্য তাঁদের স্মরণ করি --- এই টিই কবির একান্ত ইচ্ছা ; অসংখ্য ভক্তজনের হৃদয়পদ্ম হয়ে ফুটে থাকায় তাঁর একমাত্র অভিপ্রায়।  

(খ)  এই ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করেছেন সুবরদায়িনী বঙ্গজননীর কাছে।  কারণ , তাঁর কৃপা না পেলে কবির এই ইচ্ছা কখনও পূরণ হবে না।  

(গ) " তামরস "  বলতে পদ্মফুলকে বোঝানো হয়েছে।  

(ঘ) কবি মধুসূদনের একান্ত কামনা ছিল , তাঁর নশ্বর দেহটার বিনাশ হলেও তাঁর নাম অমলিন হয়ে থাকুক মানুষের মনের মণিকোঠায়।  তিব্বতের মানস সরোবরে যে পদ্মফুল সারা বছর ফুটে থেকে তার সৌন্দর্য বিতরণ করে , কবিও তেমনি সারাজীবন মানুষের স্মৃতিতে চির অক্ষয় হয়ে বিরাজ করতে চান।  অমর হয়ে মানুষের মনে থাকতে চান কবি তাঁর কীর্তি ও যশের দ্বারা।   




             

পোস্টমাস্টার

প্রশ্ন ও উত্তর    (১) ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ?  উত্তরঃ  ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি 'হিতবাদী' পত...