দেখব এবার জগৎটাকে
কাজী নজরুল ইসলাম
থাকব নাকো বদ্ধ ঘরে ; দেখব এবার জগৎটাকে ,
কেমন ক'রে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ-দেশান্তরে , ছুটছে তারা কেমন ক'রে।
কিসের নেশায় কেমন ক'রে মরছে যে বীর লাখে লাখে ,
কিসের আশায় ক'রছে তারা বরণ -মরণ যন্ত্রণাকে।
কেমন ক'রে বীর ডুবুরি সিন্ধু সেঁচে মুক্তা আনে ,
কেমন ক'রে দুঃসাহসী চলছে উড়ে স্বর্গপানে।
জাপটে ধরে ,ঢেউয়ের ঝুঁটি যুদ্ধ - জাহাজ চলছে ছুটি '-
কেমন ক'রে আনছে মানিক বোঝাই ক'রে সিন্ধু-যানে ,
কেমন জোরে টানলে সাগর উথলে উঠে জোয়ার বানে।
কেমন ক'রে মথলে পাথার লক্ষ্মী উঠেন পাতাল ফুঁড়ে ,
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয়ের চূড়ে ,
তুহিন মেরু পার হয়ে যায় , সন্ধানীরা কিসের আশায় ?
হাউই চ'ড়ে চায় যেতে কে চন্দ্রলোকের অচিনপুরে -
শুনব আমি ইঙ্গিত কোন মঙ্গল হ'তে আসছে উড়ে।
রইব নাকো বদ্ধ খাঁচায় , দেখব এবার ভুবন ঘুরে ,
আকাশ বাতাস , চন্দ্র তারায় সাগর -জলে পাহাড়-চূড়ে
আমার সীমার বাঁধন টুটে , দশ দিকেতে প'ড়ব লুটে ,
পাতাল ফেঁড়ে নামব নীচে , উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে ,
বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
সার-সংক্ষেপ :
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ' দেখব এবার জগৎটাকে ' কবিতায় এক কিশোরের সঙ্কল্পের কথা বলা হয়েছে। সে বদ্ধ হয়ে ঘরে বসে থাকবে না। সে সারা পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে , আর কোথায় কী আছে সব জানার সঙ্কল্প করেছে। সে বিভিন্ন দুঃসাহসিক অভিযান করে সব কিছুকে হাতের মুঠোর মধ্যে আয়ত্ত করে নেবে। সে দেখতে চায় মানুষ কিসের নেশায় দেশ থেকে দেশান্তরে ছুটে বেড়াচ্ছে , আর লাখে লাখে বীর যুদ্ধে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। সে এও জানতে চায় কিসের আশায় তারা মরণের যন্ত্রণাকে বরণ করে নিচ্ছে। সে জানতে চায় কেমন করে বীর ডুবুরি সমুদ্রের তলা থেকে মুক্তা তুলে আনে , কেমন করে দুঃসাহসী মানুষ রকেটে করে মহাকাশে উড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ জাহাজ কেমন করে সমুদ্রের ঢেউয়ের ঝুঁটি ধরে সমুদ্রের উপর দিয়ে ছুটে চলেছে আবার সেই জাহাজই সম্পদ বোঝাই করে নিয়ে আসছে। কেমন করে জোয়ারের টানে সাগর উথলে উঠছে ও কেমন পাতাল ফুঁড়ে মানুষ লক্ষ্মী তুলে আনছে তাও ছেলেটি জানতে চায়। ( ' পাতাল ফুঁড়ে লক্ষ্মীকে তুলে আনা ' অর্থাৎ তেলের খনি , কয়লার খনির কথা বোঝান হয়েছে। ) মানুষ অভিযান করতে কখনোও হিমালয়ের চূড়ায় উঠে যাচ্ছে , আবার কখনো তুষার মেরু পার হয়ে সন্ধানীরা ছুটে চলেছে আবিষ্কারের নেশায়। সন্ধানীরা রকেটে চড়ে চাঁদে উড়ে যাচ্ছে আর মঙ্গলগ্রহ থেকে কীসের ইঙ্গিত উড়ে আসছে সেই সম্পর্কেও সে জানতে চায়। সে একদম ঘরে বদ্ধ হয়ে থাকতে চায় না। সে সব রকম বাঁধন ভেঙে আকাশ , বাতাস , চাঁদ , তারা , সাগর -জলে ঘুরে বেড়াবে। কিশোরটি তার সীমার বাঁধন ভেঙে দশ দিকে ( দশ দিক অর্থাৎ উত্তর , দক্ষিণ , পূর্ব , পশ্চিম , ঈশান , অগ্নি , বায়ু , নৈঋত , উর্দ্ধ , অধঃ ) ছড়িয়ে পড়বে। কখনো পাতাল ভেদ করে নীচে নেমে পৃথিবীর অভ্যন্তরে দেখবে আবার আকাশ থেকে মহাকাশে ছুটে চলবে। বিশ্বজগতকে নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে পুরে ফেলে সে অসম্ভবকে সম্ভব করতে চাইছে।
জেনে রাখো :
লক্ষ্মী উঠেন পাতাল ফুঁড়ে :
পুরাণে আছে যে , একবার দেবতা ও অসুরের মধ্যে বিবাদ বাধলে লক্ষ্মী ভয়ে পাতালে গিয়ে আশ্রয় নেন। তখন দেবতা ও অসুররা সমুদ্র মন্থন করলে লক্ষ্মী বের হয়ে আসেন।
কিসের অভিযানে মানুষ চলছে হিমালয়ের চূড়ে :
মানুষের জানার আগ্রহের শেষ নেই। এই জানার আগ্রহেই তেনজিং আর এডমন্ড হিলারী এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হন।
চন্দ্রলোকের অচিনপুরে :
মানুষের অদম্য বাসনা মানুষকে জলে স্থলে অন্তরীক্ষে ঘুরিয়ে বেড়ায়। এই অদম্য বাসনার জন্যই মানুষ বিজ্ঞান বলে মহাকাশকে জয় করে চাঁদে অবতরণ করতে সক্ষম হয়েছে। চাঁদে প্রথম পা রাখেন নীল আর্মস্ট্রং ও এডউইন অলড্রিন। এটি ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের ২১ সে জুলাইয়ের ঘটনা।
প্রশ্ন ও উত্তর
(১) " দেখব এবার জগৎটাকে " কবিতায় কবি কী ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ?
উত্তর : "দেখব এবার জগৎটাকে " কবিতায় কবি পরিচিত জগতের বাইরে বেরোতে চেয়েছেন। অচেনা -অজানাকে চেনা-জানার দুর্নিবার ইচ্ছার কথাই কবি এই এই কবিতায় প্রকাশ করেছেন।
(২) কারা , কোথা থেকে মুক্তা আনে ?
উত্তরঃ ডুবুরিরা সাগর সেঁচে মুক্তা আনে।
(৩) কারা এবং কেন মৃত্যুযন্ত্রণাকে বরণ করেন ?
উত্তরঃ দেশের বীর জওয়ানরা মৃত্যুযন্ত্রণাকে বরণ করেন।
দেশের তথা দেশজননীকে সুরক্ষিত রাখতে বিদেশি আক্রমণ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করতে মরণ যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করেও তাঁরা নিজের জীবন বিসর্জন দেন।
(৪) "চন্দ্রলোকের অচিনপুরে " বলতে কী বোঝ ?
উত্তর : চাঁদ পৃথিবীর একটি উপগ্রহ। একসময় মানুষের কাছে পৃথিবীর এই উপগ্রহটি ছিল অজানা এক স্থান। কিন্তু ওই চাঁদের সম্বন্ধে জানার কৌতূহল ছিল অদম্য। তাই কবি এখানে চাঁদকে 'অচিনপুর' বলেছেন।
(৫) কারা স্বর্গের দিকে উড়ে চলেছেন ?
উত্তরঃ দুঃসাহসীরা স্বর্গের দিকে উড়ে চলেছেন।
(৬) কবি বিশ্বজগৎকে কী ভাবে দেখতে চান ?
উত্তরঃ কবি বিশ্বজগৎকে হাতের মুঠোয় পুরে দেখতে চান।
(৭) হাউই চড়ে কে কোথায় যেতে চায় ?
উত্তরঃ হাউই চড়ে মহাকাশচারীদের মতো কবিও চাঁদে ও মঙ্গলগ্রহে যেতে চায়।