সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা :
(১) " সে গান গাহিত , শাস্ত্র পড়িত না "
প্রসঙ্গ :
যে পাখিটির করুণ কাহিনি লেখক লিপিবদ্ধ করতে চলেছেন , সেই তোতাপাখিটির স্বভাব -বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আলোচ্য কথাটি বলেন।
সরলার্থ :
তোতাপাখিটি সর্বক্ষণ লাফাত , উড়ত , গান গাইত। কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়ত না, সামাজিক কোনো রীতিনীতিরও ধার ধারত না। সে ছিল " মূর্খ ". বনের মধ্যে নিজের খেয়ালখুশি মতোই জীবন কাটাত।
তাৎপর্য :
মানবশিশুর জীবনও স্বাধীন তোতাপাখির মতো। হাঁটতে চলতে এবং কথা বলতে শেখার পরই তাই সে মনের খুশিতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়। নিজের আনন্দেই কথা বলে ও গান গায়। সমাজের রীতিনীতি সে বোঝে না , বুঝতেও চায় না, এমনকি লেখাপড়াও করে না। সর্বক্ষণই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর থাকে সে।
(২) এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়। "
প্রসঙ্গ :
আলোচ্য রচনায় যে পাখিটির করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে , সেই তোতাপাখিটি সম্পর্কে রাজার মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে তাঁরই জবানিতে স্বয়ং লেখক উল্লিখিত উক্তিটি করেছেন।
সরলার্থ :
বনের তোতাপাখিটি মনের আনন্দেই বনের ফল খেত। ফলে ফলের ব্যাবসায় রাজার ক্ষতি হত। পাখিটি তাঁর কোন কাজেই লাগত না। ব্যবসা বুদ্ধিসম্পন্ন রাজার কাছে তাই তোতাপাখিটি ছিল এক মূর্তিমান লোকসান।
তাৎপর্য :
এ গল্পের রাজা পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির প্রতিভূ। এই শাসকশ্রেণি তাদের শ্রেণিগত লাভ-লোকসানের নিরিখেই বিচার করে জনগণ এবং জনগণের কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনাকে। শাসকশ্রেণির স্বার্থবিরোধী মানুষ তাদের চোখে ক্ষতিকারক ও অপ্রয়োজনীয়।
(৩) " পাখিটাকে শিক্ষা দাও "
প্রসঙ্গ :
মূর্খ পাখিটা সবসময় আপন খেয়াল খুশিতে লাফাত, উড়ত, গান গাইত। কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়ত না , সামাজিক কোনো রীতিনীতিরও ধার ধারত না সে। রাজার চোখে এমন পাখি অকাজের। তা ছাড়া বনের ফল খেয়ে সে তাঁর ফলের ব্যবসাতেও ক্ষতি করে। তাই মন্ত্রীকে তিনি এমন আদেশ দিয়েছেন।
সরলার্থ :
পাখির সহজ প্রাণচাঞ্চল্যকে অনিয়ম ও অভব্যতা বলে মনে হয়েছিল বস্তুবাদী রাজার। তাই সমাজের যান্ত্রিক নিয়মের ছাঁচে ফেলে তাকে শিক্ষিত ও পরিণত করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি।
তাৎপর্য :
পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণি , এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর পিতামাতাও শিশুদের সহজ আনন্দের প্রকৃতিপাঠে আগ্রহী নন। তবে তাঁরা উভয়েই শিশুকে শিক্ষা দিতে চান। শাসকশ্রেণি শিশুকে দিতে চায় কেরানি হয়ে ওঠার উপযোগী শিক্ষা এবং শাসকশ্রেণির বিরোধিতার উপযুক্ত শাস্তি। জৈবিকতা থেকে মানবিকতায় উত্তরণের শিক্ষা এ নয়।
(৪) " শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ"
প্রসঙ্গ :
পাখির জন্য তৈরি সোনার খাঁচাটির কারুকার্যে আকৃষ্ট হয়ে দেশ- বিদেশ থেকে দলে দলে লোক আসতে শুরু করেছিল। তাদের মধ্যে কেউই ভাবতে পারেনি যে, সামান্য পাখির শিক্ষার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে এমন এক অভিনব খাঁচা বানানো যেতে পারে। তাই আগন্তুক দর্শনার্থীদের একজন খাঁচা দেখে বিস্মিত হয়ে উক্তিটি করেছিলেন।
সরলার্থ :
"হদ্দমুদ্দ " কথাটির অর্থ হল চরম বা চূড়ান্ত বা একশেষ। প্রকৃতপক্ষে , একটি তোতাপাখির শিক্ষার জন্য যে এমন অসাধারণ সোনার খাঁচা তৈরি করা যেতে পারে , তা ভাবতেই পারেনি কেউ। আশ্চর্য ও অভিভূত হয়ে বক্তা তাই জানিয়েছেন যে , খাঁচাটি শিক্ষাব্যবস্থার একেবারে চূড়ান্ত নিদর্শন।
তাৎপর্য :
বক্তা এখানে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যানিকেতনের অলংকরণ ও বিশালতাই সাধারণ মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল। কিন্তু তারা এ কথা বুঝতে পারেনি যে , চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি করে শিক্ষার্থীর শরীর-মনের সার্থক বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।
(৫) "অল্প পুঁথির কর্ম নয় "
প্রসঙ্গ :
অত্যাশ্চর্য সোনার খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিটিকে পন্ডিত যখন শিক্ষা দিতে বসলেন তখন তিনি পুঁথির অপ্রতুলতা অনুভব করলেন। নাকে নস্যি নিয়ে প্রথমেই তিনি পুঁথির অপ্রতুলতা অনুভব করলেন। নাকে নস্যি নিয়ে প্রথমেই তিনি প্রশ্নে উল্লিখিত অভিমতটি প্রকাশ করেন।
সরলার্থ :
পুঁথি বলতে আমরা মুদ্রণ-পূর্ব -যুগের হাতে-লেখা গ্রন্থকেই বুঝি। আলোচ্য গদ্যে পন্ডিত মনে করেছিলেন যে , পাখিটিকে যথার্থভাবে শিক্ষিত করে তুলতে রাশি রাশি পুঁথির প্রয়োজন। যত বেশি-সংখ্যক পুঁথি পাখিকে পড়ানো হবে সে তত বেশি শিক্ষিত হবে।
তাৎপর্য :
ইংরেজপ্ৰবৰ্তিত আধুনিক শিশুশিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট হল শুকনো তথ্যসমৃদ্ধ পাঠ্যগ্রন্থের সংখ্যাধিক্য। শিক্ষকেরা করতেন যে , ছাত্ররা যত বেশি-সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পড়বে , তাদের বিদ্যার পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাবে। তাঁরা ভেবে দেখেন নি যে , পাঠ্যপুস্তকের পাহাড়প্রমাণ চাপ কেবল শিক্ষার্থীর চিন্তা চেতনার বিকাশই রুদ্ধ হয় না , তার স্বকীয়তা নষ্ট হয়।
(৬) "শাবাস ! বিদ্যা আর ধরে না ! "
প্রসঙ্গ :
সোনার খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিটিকে শিক্ষা দিতে গিয়ে পন্ডিত উপদেশ দিয়েছিলেন পুঁথির সংখ্যা বাড়ানোর। লিপিকররা বিভিন্ন পুঁথির অনুলিপি এবং অনুলিপির অনুলিপি করে তৈরি করলেন পাহাড়প্রমাণ পুঁথি এসব দেখেই প্রশংসাবাক্যটি উচ্চারিত হয়েছিল।
সরলার্থ :
তোতাপাখীটিকে যথার্থভাবে শিক্ষিত করতে প্রয়োজন প্রভূত পুঁথির , কারণ যত বেশি পুঁথি পড়বে পাখি, তত বেশি শিক্ষিত হবে সে। পন্ডিতের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দর্শনার্থীরা একমত ছিলেন বলে পাখির শিক্ষায় বরাদ্দ পুঁথির পরিমাণ দেখে তাঁরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।
তাৎপর্য :
ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিশুশিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পাঠ্যপুস্তকের আধিক্য। সাধারণ মানুষও মনে করতেন যে শিক্ষার্থীরা যত বেশি সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পড়বে , তারা ততই বিদ্বান হবে। তাঁরা ভাবেন নি যে, পাঠ্যপুস্তকের প্রবল চাপে শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনার বিকাশই রুদ্ধ হয় না, তার স্বকীয়তাও বিনষ্ট হয়।
No comments:
Post a Comment