বাংলাভাষা
অতুলপ্রসাদ সেন
মোদের গরব , মোদের আশা , আ মরি বাংলা ভাষা।
তোমার কোলে তোমার বোলে কতই শান্তি ভালোবাসা
কী জাদু বাংলা গানে ---
গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে !
এমন কোথা আর আছে গো
গেয়ে গান নাচে বাউল , গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।
ওই ভাষাতেই নিতাই গোরা
আনল দেশে ভক্তিধারা - ---
মরি হায় হায় রে !
আছে কই এমন ভাষা , এমন দুঃখ শ্রান্তিনাশা !
বিদ্যাপতি , চন্ডী , গোবিন
হেম মধু বঙ্কিম নবীন ---
আরও কত মধুপ গো !
ওই ফুলেরি মধুর রসে বাঁধল সুখে মধুর বাসা।
বাজিয়ে রবি তোমার বীণে ,
আনল মালা জগৎ জিনে -
গরব কোথায় রাখি গো !
তোমার চরণ -তীর্থে আজি জগৎ করে যাওয়া-আসা।
ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে
ডাকনু মায়ে "মা" "মা" বোলে ;
এই ভাষাতেই বলব "হরি " সাঙ্গ হলে কাঁদা -হাসা।
কবিতার সারসংক্ষেপ :
'বাংলা ভাষা " কবিতাটি একটি গান বিশেষ। এই গানটি কবির " গীতিগুঞ্জ " থেকে নেওয়া হয়েছে।
বাংলা ভাষা আমাদের গর্ব , আমাদের আশা -ভরসা। এই ভাষার কাছে আশ্রয় নিয়ে , এই ভাষায় কথা বলে আমরা শান্তি ও ভালোবাসার সন্ধান পাই। বাংলা গানের সম্মোহনী শক্তি আছে যা আমাদের বিভোর করে দেয়। তাই মাঝি নৌকা চালায় , বাউল নেচে বেড়ায় , কৃষক ধান কাটে এই ভাষাতেই গান গেয়ে। গৌরাঙ্গ এবং নিত্যানন্দ এই ভাষাতেই কীর্তন গেয়ে দেশে ভক্তির জোয়ার এনেছিলেন। কবির মতে বাংলা ভাষার মত এমন কোন ভাষা নেই যা আমাদের দুঃখ , ক্লান্তি সব কিছু দূর করে দেয়। মা যখন তার সন্তানকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে আদর করলে সন্তানের সমস্ত দুঃখ , কষ্ট , ক্লান্তি দূর হয়ে যায় বাংলা ভাষাও সেই রকম আমাদের মনকে সেই রকম শান্তি দেয়।
বিদ্যাপতি, চন্ডীদাস, গোবিন্দদাস, হেমচন্দ্র , মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র , নবীনচন্দ্র ও আরোও অনেক বাংলার কবি সাহিত্যিক এই ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ এই ভাষাতেই সাহিত্য সৃষ্টি করে নোবেল পুরস্কার পেয়ে আমাদের গর্বিত করেছেন।
কবি বলেছেন তিনি জন্মগ্রহণ করে বাংলাযখন তিনি ভাষাতেই প্রথম " মা" বলে ডেকেছেন , আবার এই ভাষাতেই " হরি " ডেকে জীবনের শেষ দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবেন।
মনে রাখা দরকার :
কবি এখানে তাঁর মাতৃভাষা বাংলার গুণগান গেয়েছেন। নিজের মাতৃভাষা সবার কাছে খুব প্রিয়। সেটা কারোর জন্য তামিল , কারোর জন্য হিন্দি বা কারোর জন্য মারাঠী হতে পারে। তাই মাতৃভাষা আমাদের সবার কাছে নিজের মা ও জন্মভূমির মতো প্রিয় ও গর্বের বিষয়।
ব্যাখ্যা :
(১) তোমার কোলে , তোমার বোলে
কতই শান্তি ভালোবাসা।
নিজের জন্মভূমিতে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলার মতো শান্তি আর কিছুতেই নেই। মা যেমন তাঁর সন্তানকে আদর করে কোলে তুলে নিলে সন্তানের সমস্ত দুঃখ , কষ্ট, শ্রান্তি দূর হয়ে যায় তেমনি মাতৃভাষাও তাঁর সন্তানকে কোলে ঠাঁই দেন।
(২) কী জাদু বাংলা গানে --
গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে।
কবির মতে , বাংলা ভাষার মধ্যে যেন কোনো জাদু আছে। তাই তার আকর্ষণে নৌকোর মাঝি ভাটিয়ালি গান গেয়ে নৌকো বেয়ে নিয়ে যায়। বাংলা নদীমাতৃক দেশ। বাংলা দেশের মাঝিরা নৌকো চালাতে চালাতে যে লোকসঙ্গীত গায় তার নাম ভাটিয়ালি।
( " গান গেয়ে ধান কাটে চাষা" --- চাষীও ধান কাটার সময় বাংলা ভাষায় গান গায়।
রবীন্দ্রনাথও তাঁর কবিতায় বলেছেন :
ডিঙি চ'ড়ে আসে চাষী , কেটে লয় ধান ,
বেলা গেলে গাঁয়ে ফেরে গেয়ে সারিগান " )
(৩) গেয়ে গান নাচে বাউল ,
গান গেয়ে ধান কাটে চাষা
" বাউল " বলতে বোঝায় ধর্মীয় সংকীর্নতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত সাধক সম্প্রদায়। সংগীত এঁদের সাধনার অঙ্গ। এঁরা প্রচলিত হিন্দু বা মুসলমান কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নন। এই বাউলরা একতারা বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে গ্রামের পথে পথে ঘুরে বেড়ায়।
কবি এখানে বোঝাতে চেয়েছেন যে , বাংলার মানুষ যে যে কাজই করুক না কেন সে ভাগ্যে ভাতেই গান গেয়ে কাজের কষ্ট লাঘব করে ও মনের আনন্দে কাজ করতে পারে।
(৪) ওই ভাষাতেই নিতাই গোরা
আনল দেশে ভক্তি ধারা
বাংলা ভাষায় কীর্তন অর্থাৎ কৃষ্ণের গান গেয়ে দেশে ভক্তির ধারা এনেছিল নিতাই ও গৌড়।
চৈতন্যদেব এবং তাঁর পার্ষদ নিত্যানন্দ বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে বাংলাদেশে ভক্তিধারা এনেছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের বাইরে গিয়ে অর্থাৎ হিন্দু বা মুসলমান কোন ধর্মেই না থেকে তাঁরা কৃষ্ণনাম সংকীর্তনকেই একমাত্র ঈশ্বর সাধনার পথ বলে মনে করেছিলেন। এই আদর্শেই প্লাবিত হয়েছিল জাতি -ধর্ম -নির্বিশেষে বাংলাদেশের মানুষ। নিতাই -গোরা বাংলা ভাষায় বৈষ্ণব ধর্ম প্রচার করে মানুষকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিল।
(৫)" আছে কই এমন ভাষা , এমন দুঃখ শ্রান্তি নাশা "
কবির মতে , বাংলা ভাষায় যে জাদু আছে তা শুধু প্রকাশের মাধ্যম নয় - আত্মার সঙ্গে তার যোগ। পরিশ্রমে ও সাধনায় - কৃষকের শ্রমে বা বাউলের সাধন সঙ্গীতে এই ভাষাই তাই একমাত্র অবলম্বন। এই ভাষায় গান গেয়েই পাওয়া যায় আনন্দের সন্ধান , মনের মুক্তি ও প্রশান্তির সন্ধান। তাই কবি এই ভাষাকে " দুঃখ শ্রান্তি নাশা " বলে বর্ণনা করেছেন।
(৬) আরও কত মধুপ গো
ওই ফুলেরি মধুর রসে বাঁধল সুখে মধুর বাসা
বাংলা ভাষা যেন মধুতে ভরা ফুল আর বাংলার সব কবি সাহিত্যিক হলেন মধুপ অর্থাৎ মৌমাছি। বিদ্যাপতি , চন্ডীদাস , গোবিন্দদাস , হেমচন্দ্র , মধুসূদন , বঙ্কিমচন্দ্র , নবীনচন্দ্রের মতো আরো কত কবি সাহিত্যিক বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
(৭) বাজিয়ে রবি তোমার বীণে
আনলো মালা জগৎ জিনে
"রবি" বলতে এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বোঝানো হয়েছে। বাংলা ভাষা যেন সাতটি তারের সুরে বাঁধা বীণা। সেই বীণায় গান বেঁধে জগৎবাসীকে মন জিতে বাংলার জন্য জয়ের মালা এনে দিয়েছিলেন।
যদিও " গীতাঞ্জলি" র ইংরাজী অনুবাদ করে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর কবি প্রতিভার বিচিত্র বিকাশ এই বাংলা ভাষাতেই হয়েছিল। তাই কবি হিসেবে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাওয়া আসলে বাংলা ভাষারই বিশ্বজয়।
(৮) " ওই ভাষাতেই প্রথম বোলে ,
ডাকনু 'মা' 'মা' বোলে ;
এই ভাষাতেই বলব 'হরি' সাঙ্গ হলে কাঁদা-হাসা। "
প্রতিটি শিশু তার মায়ের মুখের ভাষা অর্থাৎ মাতৃভাষাই প্রথম শেখে। মায়ের মুখের ভাষা দিয়ে তার জীবন চলা শুরু হয়। 'মা' ডাক আর মাতৃভাষায় কথা বলা এখানে সমার্থক হয়ে গেছে।
আবার যেদিন এই পৃথিবীতে জীবনের সমস্ত বোঝাপড়া শেষ হয়ে আমরা অমৃতধামে যাত্রা করব সেদিন এই মায়ের ভাষাতেই ঈশ্বরকে স্মরণ করব।
প্রশ্ন ও উত্তর :
(১) বাংলা ভাষাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি কেন ?
উত্তরঃ
আমাদের মাতৃভাষা বাংলাভাষা আমাদের গর্ব। আমাদের আশা -ভরসা , মনের যাবতীয় ভাব আমরা এই ভাষাতেই প্রকাশ করি। এই ভাষায় গান গেয়ে মাঝি নৌকা বায় , কৃষক ধান কাটে ,বাউল তার মনের মানুষ খুঁজে বেড়ায়। গৌরাঙ্গ এবং নিত্যানন্দ এই ভাষাতেই কীর্তন গেয়ে দেশে ভক্তির জোয়ার এনেছিলেন। বিদ্যাপতি , চন্ডীদাস , গোবিন্দদাস , হেমচন্দ্র , মধুসূদন , বঙ্কিমচন্দ্র , নবীনচন্দ্র ও অন্যান্য কবি-সাহিত্যিক এই ভাষাতেই কাব্য ও সাহিত্য রচনা করে খ্যাতিলাভ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছেন নোবেল পুরস্কার।
(২) বাউল কাদের বলে ?
উত্তরঃ
ধর্মীয় সংকীর্নতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত সাধক সম্প্রদায়। সঙ্গীত এঁদের সাধনার অঙ্গ। এঁরা প্রচলিত হিন্দু অথবা মুসলমান কোনো ধর্মেই বিশ্বাসী নন।
(৩) " কী জাদু বাংলা গানে "
(ক) এই ' জাদু ' র টানে মাঝি কী করেন ?
(খ) বাউল কী করেন ?
(গ) চাষী কী করেন ?
উত্তরঃ
(ক) এই জাদুর টানে মাঝিরা 'ভাটিয়ালি ' গান গেয়ে নৌকা বায়।মাঝি দাঁড় টেনে নৌকাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। একাজ খুব পরিশ্রমের। কিন্তু বাংলা গানের এমন জাদু মাঝির সেই পরিশ্রম দূর হয়ে যায় বাংলার প্রাণ মাতানো গানে।
(খ) বাউলরা গান গেয়ে ঈশ্বরের সাধনা করেন।
(গ) চাষীও ধান কাটতে কাটতে বাংলার সারিগান গায়।
( রবি ঠাকুরের কবিতায় আছে :
" ডিঙি চ'ড়ে আসে চাষি, কেটে লয় ধান,
বেলা গেলে গাঁয়ে ফেরে গেয়ে সারিগান " )
No comments:
Post a Comment