স্বাধীনতা
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়
স্বাধীনতা - হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে ,
কে বাঁচিতে চায়।
দাসত্ব-শৃঙ্খল বলো কে পড়িবে পায় হে ,
কে পরিবে পায়।
কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে ,
নরকের প্রায়।
দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গসুখ তায় হে ,
স্বর্গসুখ তায়।
ওই শুনো ওই শুনো ! ভেরির আওয়াজ হে ,
ভেরির আওয়াজ।
সাজ সাজ সাজ বলে , সাজ সাজ সাজ হে ,
সাজ সাজ সাজ।
সার্থক জীবন আর বাহুবল তার হে ,
বাহুবল তার।
আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার হে ,
দেশের উদ্ধার।
অতএব রণভূমে চলো ত্বরা যাই হে ,
চলো ত্বরা যাই।
দেশহিতে মরে যেই তুল্য তার নাই হে ,
তুল্য তার নাই।
বিষয়বস্তু :
কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি কাব্যকবিতার ছাঁদে এবং স্কট , ম্যুর , বায়রন প্রভৃতির আদর্শে স্বদেশপ্রেম ও ইতিহাসকে অবলম্বন করে কয়েকটি বীররসের আখ্যানকাব্য লিখেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে " পদ্মিনী উপাখ্যান। " জেমস টডের " Annals and Antiquities of Rajasthan " এ আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ এবং জহরব্রতে আগুন জ্বালিয়ে পদ্মিনীর আত্মাহুতি দানের যে বর্ণনা পাওয়া যায় কবির "পদ্মিনী উপাখ্যান " তারই উপর ভিত্তি করে লেখা।
কবির এই রচনায় ঐতিহাসিক পরিবেশে স্বাদেশিক রস দিয়ে বীর করুণরসের আখ্যানকাব্য রচনা করেছেন। ক্ষত্রিয়দের প্রতি রাণা ভীমসিংহের যে উৎসাহবাণী এই কবিতায় রয়েছে তা বাঙালীর স্বাধীনতার উজ্জীবন লগ্নে সমর সঙ্গীতের কাজ করেছিল।
স্বাধীনতার যুদ্ধে যোগদানের জন্য কবি সকলকে আহ্বান জানাচ্ছেন। পরাধীন হয়ে কেউ বাঁচতে চায় না। দাসত্বের শিকল কেউ পায়ে পরতে চায় না। অনন্তকাল অন্যের দাস হয়ে বেঁচে থাকা নরকযন্ত্রণার সামিল। একদিনের জন্য স্বাধীনতা পেলেও তা স্বর্গসুখের সমান। ভেরী বাজছে, তার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাজ সাজ রব উঠেছে। যোদ্ধার বেশে সবাইকে প্রস্তুত হতে হবে। নিজের জীবন বলি দিয়ে যে দেশকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে তার জীবন সার্থক , তার বাহুবল সার্থক। কাজেই আর দেরি না করে সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। দেশের মঙ্গলের জন্য যে প্রাণ দেয় তার আত্মত্যাগের কোন তুলনা নেই।
কবিতাটি কবির লেখা " পদ্মিনী উপাখ্যান " -এর একটি অংশ। পদ্মিনী মেবারের রাণা ভীমসিংহের মহিষী (স্ত্রী) । তাঁর রূপের কথা শুনে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন খিলজি মেবার রাজ্যের রাজধানী চিতোর আক্রমণ করেন। দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়। হানাদারদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য বীর রাজপুতগণ েকে েকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দিতে থাকেন। পদ্মিনী ও অন্যান্য রাজপুত রমণীগণ জহর ব্রত অবলম্বন করে আগুনে প্রাণ বিসর্জন দেন।
শব্দার্থ :
(১) স্বাধীনতা - হীনতা : স্বাধীনতা না থাকা অবস্থা অর্থাৎ পরাধীনতা
(২) দাসত্ব -শৃঙ্খল :
দাসত্বের শৃঙ্খল। একজন দাসকে পায়ে বেড়ি পরিয়ে রাখা হয়। সে তার নিজের ইচ্ছেমত চলাফেরা করতে পারে না। একজন পরাধীন মানুষও দাসের মতো। শুধু পরাধীন মানুষের ক্ষেত্রে বেড়িটা লোহার নয় , নানারকম বিধি নিষেধের। পরাধীন দেশে এই বেড়ি পরিয়ে চিন্তা ভাবনা , মত প্রকাশ ও কাজ করার অধিকার থেকে মানুষকে বঞ্চিত করা হয়।
(৩) কোটিকল্প :
অনন্তকাল। কল্প : ব্রহ্মার এক দিন = মানুষের ৪৩২ বছর।
(৪) নরক :
মৃত্যুর পরে পাপীরা যেখানে শাস্তি ভোগ করে , যমালয় , জাহান্নম , দোজখ। এটা লোকবিশ্বাস। দুঃখ কষ্টে পূর্ণ জঘন্য স্থানই হল নরক।
(৫) স্বর্গ :
দেবতাদের বাসস্থান , অমরাবতী , চিরসুখময় স্থান।
(৬) ভেরী :
চামড়ায় ঢাকা একরকম বড়ো , দুন্দুভি।
(৭) আত্মনাশ : আত্মবলি বা আত্মদান
(৮) দেশহিত : দেশের মঙ্গল
ব্যাখ্যা :
(১) কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায়
পরাধীন জীবন কেউ চায় না। তার উপর সেই জীবন যদি অনেকদিন ধরে চলতে থাকে , তার যে যন্ত্রণা তা নরকবাসের তুল্য। কারণ , স্বাধীনভাবে চলাফেরা , কাজ করা না গেলে জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে।
(২) দিনেকের স্বাধীনতা স্বর্গ-সুখ তায়
স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করার চাইতে বেশি সুখ আর কিছুতে নেই। নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছেমতো চালনা করার মধ্যে যে সুখ , যে তৃপ্তি আছে তাকেই স্বর্গের সুখের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
(৩) আত্মনাশে যেই করে দেশের উদ্ধার
পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করা সকলের কর্তব্য। দেশকে মুক্ত করতে গিয়ে যদি নিজের জীবন উৎসর্গ করতে হয় তাহলেও তার জীবন সার্থক। দেশবাসী তাঁর আত্মত্যাগ চিরকাল মনে রাখবে।
(৪) দেশহিতে মরে যেই তুল্য তার নাই
দেশের মঙ্গলের জন্য যিনি মৃত্যুবরণ করেন তাঁর ত্যাগের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা করা চলে না। কারণ নিজের জীবনের চাইতে দেশের কল্যাণকে তিনি অনেক বেশি মূল্যবান মনে করেছেন। এভাবে যাঁরা জীবনদান করেন তাঁরা শহিদ। শহিদরা চিরকাল সকলের শ্রদ্ধাভাজন।
" স্বাধীনতা " কবিতাটির মূল কথাগুলি হল :
(১) পরের অধীন হয়ে বেঁচে থাকা আর অনন্তকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করা একই কথা।
(২) অল্পকালের জন্য স্বাধীনতা পেলেও তার সুখ স্বর্গসুখের সমান। সে সুখের কোনও তুলনা হয় না।
(৩) নিজের জীবন বলি দিয়ে যে দেশকে পরাধীনতা থেকে মুক্ত করে তার জীবন সার্থক।
(৪) স্বদেশের স্বাধীনতা -সংগ্রামে যোগদান করার আহ্বান এলে সেই ডাকে সাড়া দেওয়া সকলের কর্তব্য।
(৫) দেশের মঙ্গলের জন্য যে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেয় তার জীবন ধন্য।