Friday, 6 November 2020

তোতাকাহিনী





 সার - সংক্ষেপ : 

রবীন্দ্রনাথের " লিপিকা" গ্রন্থের অন্তর্গত " তোতাকাহিনী" একটি রূপকধর্মী রচনা। ব্যঙ্গে - কটাক্ষে পূর্ন এই রচনায় আছে একটি তোতাপাখিকে শিক্ষিত করা তোলার বিবরণ।  

                         এক মূর্খ তোতাপাখি ছিল।  সে গান গাইত , লাফাত , উড়ত কিন্তু শাস্ত্র পড়ত না।  কায়দাকানুন কাকে বলে তাও  জানত না।  পাখিকে অত্যন্ত অকেজো মনে হল রাজার। তাই তিনি তাকে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।  শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব পড়ল রাজার ভাগ্নেদের ওপর।  ভাগ্নেরা শিক্ষার আয়োজনে কোনো  ত্রূটি রাখল না।  বড়ো বড়ো পন্ডিতদের আনা হল।  স্যাকরাদের দিয়ে বানানো হল সুদৃশ্য সোনার খাঁচা।  লিপিকরদের দিয়ে নকল করানো হল রাশি রাশি পুঁথি।  বহু লোক পাখিটির শিক্ষা সংক্রান্ত কোন না কোন কাজে  যুক্ত হয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে লাগল।  একসময় নিন্দুকদের মুখ থেকে খবর রটল , খাঁচার উন্নতি হচ্ছে ঠিকই , কিন্তু পাখিটার খবর কেউ রাখে না।  রাজা শুনে ভাগ্নের কাছে সব জানতে চাইলে ভাগ্নে তাঁকে সন্তোষজনক জবাব দিল।  শিক্ষা কেমন চলছে দেখার জন্য রাজা স্বয়ং একদিন শিক্ষাশালায় উপস্থিত হলেন।  বিপুল আয়োজন করে রাজাকে অভ্যর্থনা  জানানো হল।  খুশি হয়ে রাজা পাখিটিকে না দেখেই চলে যাচ্ছিলেন , কিন্তু নিন্দুকের কথায় আবার ফিরে এলেন।  তিনি দেখলেন পাখিটাকে দানাপানি দেওয়া বন্ধ হয়েছে , কেবল রাশি রাশি পুঁথির পাতা কলম দিয়ে তার মুখে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে।  গান তো বন্ধই , চিৎকার করার ও জো নেই।  রাজা দেখেশুনে খুশি হলেন।  এদিকে দিনে দিনে আধমরা পাখিটা খাঁচার বাইরে যাওয়ার জন্য ছটপট করতে থাকলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হল।  এইভাবেই একদিন মৃত্যু হল পাখিটার।  কিন্তু কেউ টের পায়নি।  নিন্দুকের কথা কানে যাওয়ায় রাজার নির্দেশে পাখিটাকে আনা হল।  রাজা পাখিটাকে টিপলেন কিন্তু " সে হাঁ করিল না , হুঁ করিল না।  কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল। " 

          তোতাপাখির এই কাহিনির  মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত  ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছেন।  তিনি দেখাতে চেয়েছেন , শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষার উপকরণ ও পদ্ধতিকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়  , তাতে প্রকৃত শিক্ষা কিছুই হয় না।  শিক্ষাকে উপলক্ষ করে খরচ হয় রাশি রাশি অর্থ , চোখ ধাঁধিয়ে যায় আয়োজনের আড়ম্বরে ; কিন্তু যার জন্য শিক্ষা , সেই শিক্ষার্থীর খোঁজ নেওয়া হয় না।  উপকরণ ও পদ্ধতির চাপে নষ্ট হয় তার প্রাণশক্তি।  উপকরণসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কী সাংঘাতিক ফাঁকি রয়েছে , লেখক এখানে তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। 


ভোরাই

 ভোরাই 

 সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত 

কবিতার প্রকৃতির বর্ণনা : 

 " ভোরাই " কথাটির অর্থ হল " ভোরের সুর " বা " ভোরবেলাকার গান"।  কবিতাটিতে কবি ভোরবেলাকার অপূর্ব প্রকৃতির এক সুন্দর দৃশ্য অঙ্কন করেছেন। উষার কোমল আলোর স্পর্শে কবি প্রকৃতির সেই অধরা মাধুরীকে নিজের সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করেছেন।  

   ভোর হতেই সূর্যের আলোয় পদ্মকলি বিকশিত হয়ে উঠেছে , সে যেন হাই তুলছে।  রাতের বেলায় পরম নিশ্চিন্ত সুপ্তিতে শায়িত নিদ্ মহল ভোরের আগমনে জাগ্রত হয়েছে - মৃদুমন্দ বাতাস যেন ' অথই  নিথর পাথার জলে " আল্পনা এঁকে দিয়েছে।  

    নিশীথের ঘোর অন্ধকারের পর আলোর ছোঁয়াতে সমস্ত মাঠ আলোকময় হয়ে উঠেছে।  দিগন্তে বিসৃত  সবুজ শ্যামল ধানক্ষেতে আজকে যেন সোহাগের শ্যামলিমার রঙ এঁকে দিয়েছে, আর 'সেই সোহাগের একটু পরাগ ' কচুরিপানার উপর বর্ষিত হয়েছে।  কবির মনে আলোড়ন তুলেছে উদার আকাশের নীল রঙ - অপরাজিতা যেন সেই নীল কাজললতা থেকেই একটু রঙ নিয়ে নিজের চোখে কাজল পরে নিয়েছে।  

   কবির মনে দাগ কেটেছে শরতের পেঁজা তুলোর মত মেঘের সারি- রৌদ্রের আলোয় স্নাত হয়ে সাদা পায়রাগুলি উড়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে আকাশ গাঙে আজ কে যেন কবুতররূপী পদ্মের পুষ্পাঞ্জলি দিয়েছে।  কবির মন আজ কল্পনার পাখায় ভর করে হালকা হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে উড়ে চলেছে নিঃসীম সৌন্দর্যলোকের দিকে।  এ যেন এক অনিকেত অভিসার যার না আছে কোন শুরু , না আছে কোন শেষ।  ভোরের অপূর্ব প্রকৃতিতে এই কল্পনাই কবির সম্বল।  

  শরতের লীলাময়ী প্রকৃতি একদিকে তার সুন্দর সুধীর সুশান্ত রূপ এবং অপরদিকে সে বিধ্বংসী।  পূর্ব আকাশের অনন্ত নীলিমা যখন মনকে তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান করে তোলে , তখনই  পশ্চিমে কালো মেঘের জটা আমাদের মনে করিয়ে দেয় ----'জীবনে সুখ -দুঃখ দুইই আছে'। আকাশে সাতটা রঙ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে আর শ্বেতশুভ্র হাঁসের দল দিগন্তের পটভূমিকায় ফুটে উঠেছে - কবি মানসে অঙ্কিত হয়েছে এক অনন্য চিত্র। পুষ্পক রথে চড়ে রামধনু রঙের পাড়ওলা শাড়ি পরে লাবণ্যময়ী অপ্সরার দল যেন গগন ভেদ করে চলেছে স্বর্গের নন্দনকাননের অভিমুখে।  কবি মানস পৌঁছে গেছে ভাব সৌন্দর্যের  জগতে। 

           শিশির কণায় মাণিক ঘনায় , দূর্বাদলে দীপ জ্বলে।....... রাতের বেলায় দূর্বার ডগায় পড়া শিশিরের থেকে রৌদ্রের আলোকের প্রতিফলন আমাদেরকে ভ্রান্ত করে - -- ভ্রম হয় সেখানে বুঝি অসংখ্য দীপ জ্বলে উঠেছে।  তার ভোরের বেলায় শীতল শিথিল শিউলি যেমন বৃন্তচ্যুত  হয়ে পড়ে যায়।  শিশুরাও তেমন মাতৃক্রোড় ত্যাগ করে চলে আসে ' রূপ রস গন্ধে ভরা ' বাস্তব জগতে।  সুখস্বপ্নের সুনিশ্চিত নিশ্চিন্তের জগৎ থেকে তারা উত্তরণ করবে বাস্তব জগতে আর জানবে যে ' এ জগৎ স্বপ্ন নয়'। 

       ভোরের বেলায় বিচিত্র সব পাখির বিচিত্র কলকাকলিতে এ জগৎ হরবোলা হয়ে উঠেছে।  যে প্রভাতে ফিঙে পাখি তার বাসা তৈরির জন্য খড়কুটো নিয়ে যাচ্ছে , বুলবুলি মিষ্টি সুর তুলেছে আর পাখির গানে আনন্দে ভরে উঠেছে সেই প্রভাতে কবির মনে প্রশ্ন জেগেছে    ........

"  আজ কি উচিত ডঙ্কা দিয়ে ঝান্ডা নিয়ে ঝড় তোলা ?"

                ছন্দের জাদুকর  সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দোময় কবিতা " ভোরাই " প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠেছে শরতের বার্তাবহ।  এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে প্রতিটি স্তবকে ফুটে উঠেছে শরৎকালীন প্রকৃতির ছন্দবদ্ধ রূপ।  পদ্মকলির হাইতোলা , দিগন্ত বিসৃত ধানক্ষেতের সবুজ রঙ , কচুরিপানায় সবজে , সবই শরৎ ঋতুর কথাই মনে করিয়ে দেয়।  পূর্বদিকে যখন ' থির নীলিমার ' মন ভুলানো রঙ , পশ্চিমদিকে তখন সিংহ কেশরের ন্যায় সজল মেঘের সারি, প্রকৃতির এই রূপ শরতেরই নিজস্ব। এর সাথে যোগ হয়েছে  পানসি ওজন পেঁজা তুলোর ন্যায় মেঘ, অপরাজিতার কাজল-নীল রঙ এবং " শীতল শিথিল শিউলি' র বৃন্তচ্যুত হয়ে পরে যাওয়া - যা সবই শরতেরই চিত্রকল্প। 


       


          




একাকারে

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালীন কবিদের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী কবি হলেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়।  যুগচেতনার প্রতিটি অনুভবের স্পন্দন আমরা তাঁর কবিতার রেণুতে রেণুতে পাই।  কবি কমিউনিজমে দীক্ষিত ছিলেন।  পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট রাজ্ প্রতিষ্ঠিত হলেও কবির স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল।  তবু কবিতার মূল  সুর আশাবাদ।  গভীর দুঃখ , অসহ লাঞ্ছনা , অপরিসীম নৈরাশ্যের ভাঙন-ধরা উপকূলে দাঁড়িয়ে তিনি আশা করেছেন এ নদীতে আসবে প্রশান্তির ভাঁটা।  আনন্দের জ্যোৎস্না চুম্বন করে যাবে এর স্থিরতোয়া জলরাশি।  প্রাণশক্তির অফুরান প্রাচুর্য তাঁর পারিপার্শ্বে জ্বালিয়ে দেবে নির্বাণহীন আলোর শিখা।  

            আমাদের পাঠ্য " একাকার " কবিতায় কবি দুই বাংলার মানুষের সর্বতোভাবে একাকার হওয়ার কথা ব্যক্ত  করেছেন কবিতার মাধ্যমে।  হিন্দু - মুসলমান দুটি সম্প্রদায় হলেও তাদের ভাষা এক, সংস্কৃতি এক......একই আচরণ।  প্রকৃতির কাছ থেকে অঞ্জলি ভরে যা আমরা পাই তা ' পানি' কিংবা ' জল ' --- কিন্তু বাস্তবে তো সবই এক।  
               আবার ধর্মের দিক থেকেও তাদের আচরণ ভিন্ন নয়।  'মা' বা 'আম্মা'  জপমালা নিয়ে একাসনে বসে 'ভগবান' বা 'আল্লা'র কাছে তার সন্তান ও  পৃথিবীর শান্তির জন্য প্রার্থনা করে।  নাম আলাদা হলেও মূল সুর ও দৃশ্য এক।  সে প্রার্থনায় কোন ফারাক নেই।  
                     আবার ভোরের উপনিষদের উদাত্ত সামবেদের  গান  কিংবা ভোরের আজানের মধ্যেও কোন প্রভেদ নেই।  সকালের প্রভাতফেরীর সঙ্গে সব মিলে  মিশে " একাকারে " হয়ে যায়।  

জন্মভূমি আজ

 কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখেছেন -- দেখেছেন তার প্রতিক্রিয়া , দেখেছেন খরা , প্রাকৃতিক বিপর্যয় , মন্বন্তর , দাঙ্গা , দেশ-বিভাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভের অনিবার্য প্রতিক্রিয়াও।  তাঁর অভিজ্ঞতার ইতিহাস তাঁর সমসাময়িক অন্যান্য মহৎ কবির মতই স্বপ্ন গড়ে তোলার ইতিহাস নয় --স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার পৰ্য্যায়ক্রমিক ইতিহাস।  

                    " জন্মভূমি আজ " কবিতাটি কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের " বেঁচে থাকার কবিতা " থেকে নেওয়া হয়েছে।  
            
         দেশ স্বাধীন হয়েছে।  কিন্তু কবি তাঁর জন্মভূমি ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে অনুভব করেছেন 
" এখনও রাত  শেষ হয় নি" । দেশের মানুষেরা এখনও ভালো নেই।  এখনও রাতের অন্ধকারের দুঃখ , কষ্টের যন্ত্রনা কঠিন পাথরের মতো মানুষের বুকে চেপে বসে আছে।  মানুষ বুক ভরে শ্বাস নিতে পারছে না। 
কবি বুঝতে পারছেন দেশবাসীর উপর দারিদ্রতা , দুঃখ-কষ্টের 'ভয়ংকর কালো আঁধার ঘনিয়ে আছে।  কিন্তু  কবি দেশবাসীকে সাহসী হতে বলছেন।  সাহসী হয়ে যে করেই হোক পাথরটিকে সরিয়ে দিতে হবে এবং রাতের অন্ধকারের মতো সাম্রাজ্যবাদী শক্তিকে জানিয়ে দিতে হবে যে তারা ভয় পায় না।  দেশকে আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হবে।  রুক্ষ , শুষ্ক  মাটিতে বৃষ্টি আসবে।  ফসল ফলাতে হবে।  নাহলে জন্মভূমি মরুভূমিতে পরিণত হবে।  যখন প্রলয় আসে , অনেক মানুষই ভয়ে পিছিয়ে যায়।  কিন্তু জন্মভূমি আমাদের প্রতীক্ষায় আছে।  তাই আমাদের ভয় পেলে চলবে না।  পরস্পরের হাত ধরে এগিয়ে যেতে হবে।   

এই জীবন

 এই জীবন 

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়  

বাঁচতে হবে  বাঁচার মতন , বাঁচতে বাঁচতে 
                                              এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে 
    জীবন্ত হোক 
আমি কিছুই ছাড়ব না , এই রোদ ও বৃষ্টি 
                                       আমাকে দাও ক্ষুদার অন্ন 
                                                              শুধু যা নয় নিছক অন্ন 
                                                               আমার চাই সব লাবণ্য 
                                       নইলে গোটা দুনিয়া খাব ! 
                                       আমাকে কেউ গ্রামে-গঞ্জে ভিখারি করে 
                                                                পালিয়ে যাবে ? 
                                       আমায় কেউ নিলাম করবে সুতো করে , 
                                                                 কামারশালায় ? 
                                       আমি কিছুই ছাড়ব না আর , এখন আমার 
                                                                  অন্য খেলা 
                                      পদ্মপাতার ফড়িং যেমন আপনমনে খেলায় মাতে 
                                                                  গোটা জীবন 
                                       মানুষ সেজে আসা হলো , 
                                                                 মানুষ হয়েই ফিরে যাব 
                                    বাঁচতে হবে বাঁচার মতন , বাঁচতে বাঁচতে 
                                                               এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে 
                                                               জীবন্ত হোক ! 


উৎস :
 " দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায় " কাব্যগ্রন্থ 

বিষয় সংক্ষেপ : 

'এই জীবন '  কবিতাটিতে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মানুষকে মানুষের মতো বাঁচার কথা বলেছেন।  কবি আমাদের জীবনকে 'জীবন্ত' করে তুলতে চেয়েছেন।  কবিতাটিতে বহুবারই মানুষের মতো বাঁচার কথা বলা হয়েছে।  এর থেকে সন্দেহ জাগে আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি।  কবির মতে বহু মানুষই বেঁচে আছে শুধুমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে।  কখনও অভাবের তাড়নায় শুধুমাত্র দুবেলা দু-মুঠো  অন্ন জোগানোকেই অনেকে মনে করে বেঁচে থাকা।  আবার যাদের অন্নচিন্তা নেই সেই মানুষগুলোও শুধুমাত্র অভ্যাসের বশে খেয়ে-ঘুমিয়ে শারীরিকভাবে বেঁচে আছে।  কবি এই দুই ধরণের মানুষকেই বলেছেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে।  কবি মনে করেন এই পৃথিবীর রূপ -রস- গন্ধ -স্পর্শ সবকিছুকে আস্বাদন করে বাঁচাই মানুষের মতো বাঁচা। তিনি তাঁর জীবন থেকে কিছুই বাদ দিতে চান না।  রোদ-বৃষ্টি, প্রকৃতি যা কিছু পৃথিবীর মানুষের জন্য ঢেলে দিচ্ছে সেই সবকিছুই কবি চাইছেন আস্বাদন করতে।  কবি বলছেন, তাঁর ক্ষুধার অন্নও চাই , কিন্তু সেই অন্ন যেন নিছক দেহকে বাঁচানোর জন্যই না হয় , তা যেন মনেরও খাদ্য জোগায়।  কবি এও বলেছেন , 'নইলে গোটা দুনিয়া খাব'।  এই পংক্তিটির মধ্যে দিয়ে কবির ক্ষোভপূর্ন প্রতিবাদের মূর্তিটি চোখে পড়ে।  তিনি যেন পৃথিবীর বাকি ক্ষুধার্ত মানুষদেরও দাবী করতে বলছেন।  কবি বলছেন , তাঁকে কেউ বঞ্চিত করে রাখবে , ঠকিয়ে ভুলিয়ে রাখবে। সুতোর কলে , কামারশালায় তাকে নিলাম করবে তা তিনি সহ্য করবেন না।  অর্থাৎ তিনি 'পণ্য' হিসেবে ব্যবহৃত হতে নারাজ।  মানুষের মনুষত্বের বিকাশ তার স্বাধীনতার অস্তিত্বে , মানুষ যদি সেই স্বাধীনতা খুইয়ে শুধুমাত্র পণ্য হিসেবে ব্য়বহৃত হয় তাহলে হয় মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা।  কবি তা কিছুতেই হতে দেবেন না।  তিনি নিজের 'মানুষ' হিসাবে বাঁচার অধিকার যেমন করে হোক আদায় করে নেবেন।  তিনি যখন পৃথিবীতে এসেছিলেন তখন শুধু মানুষের মত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে অর্থাৎ শারীরিক ভাবে (মানুষ সেজে আসা ) এসেছিলেন , কিন্তু তিনি চান যখন তিনি আবার ফিরে  যাবেন তখন শুধু মানুষের শরীর নিয়ে নয়, মানুষের সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে ফিরে  যাবেন। তিনি আমাদের সবাইকে মানুষের মত বেঁচে উঠতে বলছেন , তবেই জীবনটা জীবন্ত হয়ে উঠবে।  






খেয়া

 


উৎস : 


১৯১১ খ্রিস্টাব্দে  প্রকাশিত  " চৈতালী " কাব্যগ্রন্থের ১৩ সংখ্যক কবিতা " খেয়া" ।   
         কবি ১৩০২ বঙ্গাব্দে পূর্ববঙ্গের পতিসরে নদীবক্ষে জমিদারীর কাজ উপলক্ষ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।  সেই সময় অধিকাংশ সময়ই তিনি নদীবক্ষে বোটেই থাকতেন। নদীমাতৃক বাংলার নদনদীর তীর , 
তীরবর্তী গ্রাম , সেখানকার মানুষের সহজসরল অনাড়ম্বর জীবনকে নিবিড় কৌতূহলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।  সেই আটপৌরে প্রকৃতির পটে যে-জীবনকে তিনি দেখেছেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে আবহমান জীবনের ছবি কবি তাঁর এই "খেয়া " কবিতাটি লিখেছেন।


কবিতার সারসংক্ষেপ :

স্বয়ং কবি " খেয়া " কবিতাটি প্রসঙ্গে বলেছেন যে , এটি একটি স্থানিক রঙে রঞ্জিত কবিতা।  এই স্থানিক রংটি  হল একটি নদী , তার দুই তীরে দুটি গ্রাম , প্রতিদিনের আনাগোনায় তারা পরস্পরের পরিচিত।  নদীবক্ষে ভেসে  চলেছে নৌকা, সে নৌকায় কেউ ঘর ছেড়ে বিশ্বজীবনের পথে পা রাখে , আবার কেউ ঘরে ফেরে। একান্তই নিরাভরণ একটি সাদামাটা জীবন।  এ জীবন দেখতে দেখতেই কবির মনে একটি ভাবনার উদয় হয়েছে।  এই পৃথিবীতে কত 
দ্বন্দ্ব-রেষারেষি , রক্তক্ষয় , সাম্রাজ্যের উত্থানপতন প্রতি মুহূর্তে ঘটে চলেছে।  কিন্তু তার কোনো ছায়া এই একান্তই নিরাভরণ , সরল, অনাড়ম্বর নদী তীরবর্তী গ্রাম্য জীবনে পড়ে না।  তাদের কেউ জানেও না ,চেনেও না। নদীর উভয় তীরের গ্রাম দুটি শুধু নিজেরাই নিজেদেরকে জানে  , চেনে, পরস্পর পরস্পরকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকে।  অনন্তকাল ধরে এই নদীপথেই খেয়া চলে চিরদিন। 
এ খেয়া হল জীবনের খেয়া -অনন্ত মানবপ্রবাহ।  নাগরিক সভ্যতার উত্থানপতন , তার 'নব নব তৃষ্ণা ' ,' ক্ষুধা ' ,হলাহল  বা  অমৃত কোন কিছুই স্পর্শ করতে পারে না।  
               পৃথিবীর ইতিহাস হল রক্তক্ষয়ী দ্বন্দ্বসংঘাতের ইতিহাস।  লোভের আগুনে পুড়ে যায় মানবতা।  ধ্বংসলীলায় মত্ত ক্ষমতাদর্পীদের হানাহানিতে সাম্রাজ্যের উত্থানপতন ঘটে অনবরত।  সোনার মুকুট যেমন 'ফুটে' আবার 'টুটে'ও।  কিন্তু প্রবহমান মানবসভ্যতার প্রেক্ষাপটে সাম্রাজ্যলোভীদের বিজয়গৌরব তুচ্ছ ঘটনামাত্র।  ক্ষমতার দম্ভ জলের  বুদ্বুদের মতই ক্ষণস্থায়ী।  ক্ষমতার দর্পে উন্মত্ত মানুষের প্রমত্তলীলা সভ্যতাকে শুধু কলঙ্কিতই করেছে।  
তবু এই ধ্বংসের মধ্য দিয়েই জীবন বয়ে চলেছে নদীর স্রোতে ভাসা      'খেয়া ' র মতই।  




তিন পাহাড়ের কোলে

 তিন পাহাড়ের কোলে 


শক্তি  চট্টোপাধ্যায় 


মূল বিষয় সংক্ষেপ : 

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ' তিন পাহাড়ের কোলে ' কবিতায় এমন একটি জগতের বর্ণনা দিয়েছেন যা   

প্রতিটি শহরবাসীর স্বপ্ন।  শহরের কর্মব্যস্ত জীবন ছেড়ে প্রতিটি মানুষ চায় " তিন পাহাড়ের কোলে "র  

মতো এক শান্ত সবুজ প্রাকৃতিক পরিবেশে কাটিয়ে আসতে।  কবি ও তার দুই বন্ধু একদিন রাত্রিতে তিন 

পাহাড়ের কোলে নেমে তাদের কী অভিজ্ঞতা হল তারই বর্ণনা রয়েছে এই কবিতায়।  
  
                   বিশুদ্ধ , টাটকা বাতাস সেবনের নিমিত্তে তিনজন শহরবাসী পাহাড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।  

পাহাড়ে  পৌঁছে সেখানকার নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে তাদের চোখ সরতে চায় না।  ফ্রেমে  আঁটা  

ফোটোর  মতো সেই আলো -আঁধারি দৃশ্য দেখে মন জুড়িয়ে যায়।  স্টেশনে কোনো মানুষের দেখা নেই।   
মাথার উপরে খোলা আকাশ, তারায় তারায় ভরা প্রভৃতি যেন উজাড় করে দিয়েছে তার সৌন্দর্য।  এরকম     
একটি  জায়গা আসলে , সুদূর অতীত ভুলে গিয়ে সবাই পথ হারিয়ে ফেলবে।  ঝরনা  , টিলা , পাথুরে  

বনভূমির মধ্যে  শহুরে সড়ক নেই , কিন্তু যা আছে  তা কিছু কম নয়।  পাহাড়ি উঁচু নীচু পথ , গাড়ি-

ঘোড়ার উৎপাত নেই , নির্জন , নিরালা পথে পথিক আপন মনে  হেঁটে চলে। মনের ভূমিতে পাহাড়ি 

বনভূমির সৌন্দর্য রেখাপাত করে, মন আরো চায় বনভূমির ওপারের না দেখা নিসর্গ কত অসাধারণ , 

যেমন মনে হয় স্বপ্নে তারা এসে কথা বলে যায় , হাতছানি দিয়ে ডাকে।  ধীরে ধীরে পাহাড়ের মাথায় 

রক্তিম সূর্য প্রকৃতিকে আবির রঙে রাঙিয়ে দেয়।  সবুজে ঘেরা গ্রাম দেখা যায় তিন পাহাড়ের গায়ে।  শক্ত 

পোক্ত মানুষগুলো দৈনিক কর্মে প্রবৃত্ত হয়।  এরকম সহজ , সরল জীবন শুধুমাত্র পাহাড়ি কোন গ্রামেই 

অতিবাহিত  করা সম্ভব।  শহুরে পায়রার খোপে শুধু বিষাক্ত বাতাস , সেখানে থাকা কী সম্ভব ? তিনটি   

পাহাড়  দিয়ে যেন সবুজ  কাঁথায় নকশা আঁকা হয়েছে।  সেই সবুজের উপর অবোধ শিশুরা নিশ্চিন্তে  

খেলা করে।  খোলা -মেলা বিশুদ্ধ বাতাসে তাদের ছোটা বা চিৎকার করার সীমা পরিসীমা নেই।  









পোস্টমাস্টার

প্রশ্ন ও উত্তর    (১) ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ?  উত্তরঃ  ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি 'হিতবাদী' পত...