এই জীবন
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
বাঁচতে হবে বাঁচার মতন , বাঁচতে বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক
আমি কিছুই ছাড়ব না , এই রোদ ও বৃষ্টি
আমাকে দাও ক্ষুদার অন্ন
শুধু যা নয় নিছক অন্ন
আমার চাই সব লাবণ্য
নইলে গোটা দুনিয়া খাব !
আমাকে কেউ গ্রামে-গঞ্জে ভিখারি করে
পালিয়ে যাবে ?
আমায় কেউ নিলাম করবে সুতো করে ,
কামারশালায় ?
আমি কিছুই ছাড়ব না আর , এখন আমার
অন্য খেলা
পদ্মপাতার ফড়িং যেমন আপনমনে খেলায় মাতে
গোটা জীবন
মানুষ সেজে আসা হলো ,
মানুষ হয়েই ফিরে যাব
বাঁচতে হবে বাঁচার মতন , বাঁচতে বাঁচতে
এই জীবনটা গোটা একটা জীবন হয়ে
জীবন্ত হোক !
উৎস :
" দেখা হলো ভালোবাসা বেদনায় " কাব্যগ্রন্থ
বিষয় সংক্ষেপ :
'এই জীবন ' কবিতাটিতে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মানুষকে মানুষের মতো বাঁচার কথা বলেছেন। কবি আমাদের জীবনকে 'জীবন্ত' করে তুলতে চেয়েছেন। কবিতাটিতে বহুবারই মানুষের মতো বাঁচার কথা বলা হয়েছে। এর থেকে সন্দেহ জাগে আমরা কি সত্যিই বেঁচে আছি। কবির মতে বহু মানুষই বেঁচে আছে শুধুমাত্র প্রয়োজনের তাগিদে। কখনও অভাবের তাড়নায় শুধুমাত্র দুবেলা দু-মুঠো অন্ন জোগানোকেই অনেকে মনে করে বেঁচে থাকা। আবার যাদের অন্নচিন্তা নেই সেই মানুষগুলোও শুধুমাত্র অভ্যাসের বশে খেয়ে-ঘুমিয়ে শারীরিকভাবে বেঁচে আছে। কবি এই দুই ধরণের মানুষকেই বলেছেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গী পাল্টাতে। কবি মনে করেন এই পৃথিবীর রূপ -রস- গন্ধ -স্পর্শ সবকিছুকে আস্বাদন করে বাঁচাই মানুষের মতো বাঁচা। তিনি তাঁর জীবন থেকে কিছুই বাদ দিতে চান না। রোদ-বৃষ্টি, প্রকৃতি যা কিছু পৃথিবীর মানুষের জন্য ঢেলে দিচ্ছে সেই সবকিছুই কবি চাইছেন আস্বাদন করতে। কবি বলছেন, তাঁর ক্ষুধার অন্নও চাই , কিন্তু সেই অন্ন যেন নিছক দেহকে বাঁচানোর জন্যই না হয় , তা যেন মনেরও খাদ্য জোগায়। কবি এও বলেছেন , 'নইলে গোটা দুনিয়া খাব'। এই পংক্তিটির মধ্যে দিয়ে কবির ক্ষোভপূর্ন প্রতিবাদের মূর্তিটি চোখে পড়ে। তিনি যেন পৃথিবীর বাকি ক্ষুধার্ত মানুষদেরও দাবী করতে বলছেন। কবি বলছেন , তাঁকে কেউ বঞ্চিত করে রাখবে , ঠকিয়ে ভুলিয়ে রাখবে। সুতোর কলে , কামারশালায় তাকে নিলাম করবে তা তিনি সহ্য করবেন না। অর্থাৎ তিনি 'পণ্য' হিসেবে ব্যবহৃত হতে নারাজ। মানুষের মনুষত্বের বিকাশ তার স্বাধীনতার অস্তিত্বে , মানুষ যদি সেই স্বাধীনতা খুইয়ে শুধুমাত্র পণ্য হিসেবে ব্য়বহৃত হয় তাহলে হয় মনুষ্যত্বের চরম অবমাননা। কবি তা কিছুতেই হতে দেবেন না। তিনি নিজের 'মানুষ' হিসাবে বাঁচার অধিকার যেমন করে হোক আদায় করে নেবেন। তিনি যখন পৃথিবীতে এসেছিলেন তখন শুধু মানুষের মত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নিয়ে অর্থাৎ শারীরিক ভাবে (মানুষ সেজে আসা ) এসেছিলেন , কিন্তু তিনি চান যখন তিনি আবার ফিরে যাবেন তখন শুধু মানুষের শরীর নিয়ে নয়, মানুষের সমস্ত অস্তিত্ব নিয়ে ফিরে যাবেন। তিনি আমাদের সবাইকে মানুষের মত বেঁচে উঠতে বলছেন , তবেই জীবনটা জীবন্ত হয়ে উঠবে।
No comments:
Post a Comment