বিদূষক
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'বিদূষক ' গল্পটি লেখকের 'লিপিকা' গ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।
গল্পে কাঞ্চীর রাজা একজন নির্মম ও নৃশংস রাজা। তিনি কর্ণাট জয় করে চন্দন , হাতির দাঁত , সোনা মানিক লুঠ করে হাতি বোঝাই করে দেশে ফিরে চলেছেন। তিনি এতটাই নির্মম যে যুদ্ধের হত্যাতেই থেমে থাকেন নি যুদ্ধ থেকে ফেরার পথে বলেশ্বরীর মন্দির বলির রক্তে ভাসিয়ে পুজো দিলেন। তাঁর রক্তবস্ত্র , রক্তচন্দনের তিলক আর জবার মালা উগ্র সেই নির্মমতারই বর্ণ - সংকেত। পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় রত কর্ণাটের ছেলের দল যখন 'বুক ফুলিয়ে ' কাঞ্চী রাজকে বলল যে , তাদের এই খেলায় কর্ণাটের জিত আর কাঞ্চীর হার তখন কাঞ্চীরাজের ' চক্ষু রক্তবর্ণ ' হয়ে উঠল। ছেলেদের গাছের সঙ্গে বেঁধে বেত্রাঘাতের আদেশ দেওয়া হল। অবোধ ছেলেদের জন্য গ্রাম থেকে ছুটে আসা মা-বাপের মার্জনাভিক্ষায় রাজার ক্রোধ যেন আরো জ্বলে উঠল। 'কাঞ্চীর রাজাকে কোনোদিন যেন ভুলতে না পারে ' - গ্রামকে এমন শিক্ষাদানের জন্য সেনাপতিকে হুকুম করে রাজা শিবিরে চলে গেলেন। সেনাপতি সন্ধেবেলায় এসে জানাল ,'শৃগাল কুকুর ছাড়া এ গ্রামে কারো মুখে শব্দ শুনতে ' পাওয়া যাবে না। হত্যাকাণ্ডের ইঙ্গিতটি এখানে অস্পষ্ট রয়ে গেছে। গ্রামের এই উচিত শিক্ষায় স্বস্তি লাভ করে মন্ত্রী বললেন " মহারাজের মান রক্ষা হল " , আর পুরোহিত রাজার প্রশস্তি করে বললেন , 'বিশ্বেশ্বরীর মহারাজের সহায়। "
গল্পে বিদূষক একবার মাত্র হেসেছে। সেই হাসিই যেন তার প্রতিবাদ। গল্পের শেষে বিদূষক নির্মম কাঞ্চীর রাজার সভা থেকে বিদায় নিলেন।
"বিদূষক"গল্পের মূল কথা :
'বিদূষক' অর্থাৎ রাজার রসিক সহচর যার কাজ রাজাকে হাসানো। কাঞ্চীর রাজা সর্বদা বিদূষক নিয়ে চলেন। কিন্তু সম্পূর্ণ গল্পে রাজাকে একটি বারের জন্যও হাসতে দেখা যায় না। বরং কর্ণাটজয়ী কাঞ্চীর রাজা অত্যন্ত নির্মম। বলেশ্বরীর মন্দির বলির রক্তে ভাসিয়ে পুজো দেওয়া , তাঁর রক্তবস্ত্র , রক্তচন্দনের তিলক , জবার মালা সবকিছুই তাঁর নির্মমতারই প্রতীক। এমনকি ছোটশিশুদের খেলাকেও তিনি সহজভাবে না নিয়ে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠে সম্পূর্ণ গ্রামকে কঠিন শাস্তি দেন। শক্তির অহংকারে উন্মত্ত কাঞ্চীররাজার বিরুদ্ধে কেউই মাথা তুলে দাঁড়ায় না। একমাত্র ব্যতিক্রম বিদূষক। বজ্রপাত শুধুমাত্র একটি জায়গাকে ধ্বংস করতে পারে কিন্তু রাজরোষ সমগ্র রাজ্যকেই ধ্বংস করে দিতে পারে। বিদূষক বুঝতে পেরেছিল শক্তির গর্বে উন্মত্ত এই কাঞ্চীর রাজ্যে কোন আনন্দ , শান্তি কিছুই থাকবে না। তাই সে কাঞ্চীর রাজার সভা ত্যাগ করে চলে যায়। বিদূষক এই গল্পে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নিঃশব্দ প্রতীক।
প্রশ্ন ও উত্তর
(১) ' পুজো দিয়ে চলে আসছেন '
(ক) কে কখন কোথায় পুজো দিয়ে ফিরছিলেন ?
(খ) ফেরার পথে তিনি কী দেখলেন ?
উত্তর :
(ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা " বিদূষক " গল্পে কাঞ্চীর রাজা কর্ণাট জয় করার পরে বলেশ্বরী মন্দির থেকে পুজো দিয়ে ফিরছিলেন।
(খ) ফেরার পথে রাজা দেখলেন যে রাস্তার ধারে আমবাগানে একদল ছেলে পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছে।
(২) " এ গ্রামে কারো মুখে শব্দ শুনতে পাবেন না "
(ক) কে কাকে কথাটি বলেছেন ?
(খ) কোন প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে ?
(গ) কথাটি শুনে মন্ত্রী , পুরোহিত ও বিদূষক কী বলেছিলেন ?
উত্তরঃ
(ক) কাঞ্চীর সেনাপতি কাঞ্চীর রাজাকে কথাটি বলেছেন।
(খ) কাঞ্চীর রাজা সেনাপতিকে বলেছিলেন যে গ্রামের ছেলেদের গাছে বেঁধে বেত মারতে এবং সেই গ্রামকে এমন শাস্তি দিতে যে এই গ্রাম কখন যেন কাঞ্চীর রাজাকে ভুলতে না পারে। এই প্রসঙ্গে কথাটি বলা হয়েছে।
(গ) মন্ত্রী বলেছিলেন 'মহারাজের মান রক্ষা হল ' , পুরোহিত বলেছিলেন ' বিশ্বেশ্বরীর মহারাজের সহায়' এবং বিদূষক বলেছিলেন তাঁকে বিদায় দিতে।
(৩) " ওরা অবোধ , ওরা খেলা করছিল "
(ক) " ওরা " বলতে এখানে কাদের কথা বলা হয়েছে ?
(খ) ওরা কী করছিল ?
(গ) রাজা ওদের জন্য কী হুকুম দিয়েছিলেন ? কেন ?
উত্তরঃ
(ক) " বিদূষক " গল্পে কাঞ্চীর রাজা যখন মন্দির থেকে পুজো দিয়ে ফিরে আসছিলেন তখন তিনি একদল ছেলেকে পথের ধারে আমবাগানে খেলতে দেখেছিলেন। এখানে 'ওরা' বলতে ওই ছেলের দলের কথা বলা হয়েছে।
(খ) ওরা দুই সারি পুতুল নিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল।
(গ) রাজা ওদের জন্য সেনাপতিকে হুকুম দিয়েছিলেন যে সব কটা ছেলেকে গাছের
সাথে বেঁধে বেত মারতে।
কর্ণাটের সঙ্গে কাঞ্চীর যুদ্ধে কাঞ্চীর রাজার জয় হয়েছিল, কিন্তু ছেলেরা গর্বের সঙ্গে বলেছিল কর্ণাটের জিত আর কাঞ্চীর হার। তাই ক্রোধে উন্মত্ত কাঞ্চীর রাজা ওদের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন।
(৪) " মহারাজের সভায় থাকলে আমি হাসতে ভুলে যাব "
(ক) বক্তা কে ?
(খ) তিনি কোন মহারাজের সভায় ছিলেন ?
(গ) কেন তিনি হাসি ভুলে যাবার কথা বলেছিলেন ?
উত্তরঃ
(ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত " বিদূষক " গল্পে এখানে বক্তা হল বিদূষক।
(খ) তিনি কাঞ্চীর রাজার সভায় ছিলেন। তাঁর কাজ ছিল লোককে হাসানো এবং আনন্দিত রাখা আর নিজেকেও আনন্দিত রাখা।
(গ) কাঞ্চীর রাজা সেনাপতিকে হুকুম দিয়েছিলেন যে ছেলেদের গাছের সঙ্গে বেঁধে বেত মারতে এবং গ্রামটিকে এমন শিক্ষা দিতে যে তারা যেন কাঞ্চীর রাজাকে কোনদিন ভুলতে না পারে। বিদূষকের কাজ হল লোকেদের হাসানো আর আনন্দে রাখা। যদি তিনি এমন নির্মম রাজায় সভায় থাকেন যে খুব অহংকারী এবং অত্যাচারী তাহলে তিনি নিজে হাসতে ভুলে যাবেন আর রাজার মতন অত্যাচারী হয়ে যাবেন।
(৫) " বিদূষক হা-হা করে হেসে উঠল "
(ক) অংশটি কার লেখা , কোন রচনা থেকে গৃহীত ?
(খ) বিদূষক হেসে উঠেছিল কেন ?
(গ) তখন রাজা কী হুকুম দিলেন ?
উত্তরঃ
(ক) অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা " বিদূষক " রচনা থেকে গৃহীত।
(খ) কাঞ্চীর রাজা অস্ত্রবলে ও সৈন্যবলে কর্ণাটের রাজার থেকে শক্তিশালী হতে পারেন , কাঞ্চীর রাজা যুদ্ধে কর্ণাটের রাজাকে পরাজিত করে কর্ণাট জয় করতে পারেন , কিন্তু তাতে মানুষের মন জয় করতে পারেন না। অবোধ শিশুরাও নিজেদের রাজার জয় চায়। তাই তারা কর্ণাটের সঙ্গে কাঞ্চীর 'যুদ্ধ যুদ্ধ ' খেলার ফল হিসেবে 'কর্ণাটের জয় , কাঞ্চীর হার ' বলে। অবোধ শিশুদের মনে ভয় থাকে না , তাই তারা মনের কথা সত্যি করে বলতে পেরেছে। মদমত্ত রাজা ,শিশুদের সহজ জবাবে হেসে খেলাটি উপভোগ করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে উঠলেন। সহজ-সুন্দর হাসির উপাসক বিদূষক ছেলেদের এই খেলা ও কথা শুনে হেসে উঠল।
(গ) কাঞ্চীর রাজা সেনাপতিকে হুকুম দিয়েছিলেন যে ছেলেদের গাছের সঙ্গে বেঁধে বেত মারতে এবং গ্রামটিকে এমন শিক্ষা দিতে যে তারা যেন কাঞ্চীর রাজাকে কোনদিন ভুলতে না পারে।
(৬) " দেখে আসি ওরা কি খেলছে। "
(ক) উক্তিটি কার ?
(খ) 'ওরা " বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে ?
(গ) তারা কোথায় কী খেলছিল ?
উত্তরঃ
(ক) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'বিদূষক ' গল্পে উক্তিটি কাঞ্চীর রাজার।
(খ) 'ওরা ' বলতে আমবাগানে যে ছেলেগুলি খেলছিল তাদের কথা বলা হয়েছে।
(গ) ছেলেরা আমবাগানে দুই সারি পুতুল সাজিয়ে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলছিল।