Friday, 6 November 2020

রথযাত্রা

 


রথযাত্রা :  

মনে রাখার বিষয় :  

    • রথযাত্রা " গল্পটি নেওয়া হয়েছে " লিপিকা " গ্রন্থ থেকে 
    • " রথযাত্রা " প্রসঙ্গে গীতাঞ্জলির কবিতা বিশেষ ভাবে স্মরণীয় :    
    •     (১) এসো হে পতিত করো অপনীত /সব অপমানভার 
    •     (২) যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন / সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে / সবার পিছে , সবার নীচে,/ সব-হারাদের মাঝে 
    •   (৩)  'হে মোর দুর্ভাগা দেশ , যাদের করেছ অপমান / অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

গল্প শুরু হয় রথযাত্রার দিন।  রাজা ও রানি রথ দেখতে যাবেন।  তাই তার প্রস্তুতি শুরু হল।চারিদিকে 'সাজো' ' সাজো 'রব উঠল।    ঘোড়াশালা থেকে ঘোড়া , হাতিশালা থেকে হাতি এল।  ময়ূরপঙ্খী সাজান হল।  বল্লম হাতে সারি সারি সিপাই সান্ত্রী , দাস-দাসী সবাই রাজা -রানির সঙ্গে চলল।  কেবল একজন গেল না---দুঃখী গেল না রাজার সাথে।  দুঃখীর কাজ হল রাজবাড়িতে ঝাঁটার কাঠি কুড়িয়ে আনা। সর্দারের দয়া হল।  সে দুঃখীকে তাদের সঙ্গে যেতে বলল।  কিন্তু দুঃখী বলল তার যাওয়া হবে না।  রাজামশাই জানতে পারলেন।  সবাই যাচ্ছে , শুধু সেই দুঃখী যাচ্ছে না।  রাজামশায়েরও দয়া হল।  তিনি মন্ত্রীকে বললেন দুঃখীকে ডেকে নিতে। দুঃখীর বাড়ি রাস্তার ধারে। রাজার হাতি যখন সেখানে পৌঁছল তখন মন্ত্রী তাকে ডেকে তাদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতে বললেন।  দুঃখী বলল ঠাকুরের দুয়ার পর্যন্ত পৌঁছায় তার সাধ্য নেই।  মন্ত্রী তাকে অভয় দিয়ে বলল সে রাজার সঙ্গে যাবে কাজেই তার কোন চিন্তা নেই।  দুঃখী উত্তরে জানাল রাজার পথ আর তার পথ এক হতে পারে না।  মন্ত্রী বললেন তাহলে দুঃখীর ভাগ্যে কী করে "রথযাত্রা " দর্শন হবে।  দুঃখী মন্ত্রীকে জানাল ঠাকুর রথে করে তার দুয়ারেই আসেন।  দুঃখীর এই কথায় মন্ত্রী হেসে উঠে জিজ্ঞাসা করলেন তার দুয়ারে ঠাকুরের রথের চিহ্ন কোথায়।  দুঃখী তাঁকে জানায় তার দুয়ারে ঠাকুর আসেন পুষ্পক রথে করে তাই  ঠাকুরের রথের চিহ্ন পড়ে না।  সে তার দুয়ারের দুই পাশে দুটি সূর্যমুখী ফুল দেখিয়ে বলে ঐটাই ঠাকুরের রথ।  
         "রথযাত্রা " রবীন্দ্রনাথের একটি প্রতীকি  গল্প। ছোট এই গল্পটির মাধ্যমে কবি একটি বড়ো সত্যকে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন।  
            পুষ্পক রথ পুষ্পেরই রথ।  সূর্যমুখী ফুল অর্থাৎ সূর্যের রথ।  দুই পাশে দুটি সূর্যমুখী সেই পুষ্পরথের হলুদে আর কালোয় বলয়িত দুটি চাকা। সূর্যের আলোয় ফুটে ওঠা পৃথিবীর ফুল যেমন অত্যন্ত স্বাভাবিক , নির্মল তেমন দুঃখীর মত যারা মাটির কাছের মানুষ তারাও ঈশ্বরের করুণা থেকে কখনও বঞ্চিত হয় না।  ঈশ্বরকে পাওয়ার জন্য তাদের রাজা , মন্ত্রী বা সর্দারের দয়ার কোন প্রয়োজন নেই।  ঈশ্বর সর্বত্র বিরাজমান।  তাই তাঁকে দেখার জন্য কোন অয়োজনের প্রয়োজন পরে না।  মনের চোখ থেকে দেখলে আমাদের আশেপাশেই তাঁকে দেখা যায়।   



আহ্বান

 আহ্বান 

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য 

"আহ্বান " কবিতাটি কবি সুকান্তর " অভিযান " কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।  " অভিযান " কাব্যগ্রন্থে "সূর্যপ্রণাম " কাব্যের একটি অংশ "আহ্বান" । এটিকে কবি সমবেত গান হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।  

      কিশোর কবি সুকান্ত দেশের যুবসমাজকে ডাক দিয়েছেন সবাইকে পথে নেবে একসাথে চলার জন্য।  নতুন দিনের সূর্য সবাইকে  আহ্বান জানাচ্ছে। আকাশ সূর্যের আহ্বান অগ্রাহ্য করে কেই বা ঘরের মধ্যে বসে থাকতে পারে !  পৃথিবীর সবাই এগিয়ে চলেছে , আমাদের তাদের সঙ্গে সমান তালে পা মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।  পিছিয়ে পড়লে চলবে না।  সকাল -সন্ধ্যা সূর্য আমাদের পথের সঙ্গী হয়ে চলেছে।  

        ঘুম ভেঙে জেগে ওঠ।  পথে নেবে পথের সাথী ও পথ উভয়কেই চিনে নিতে হবে।  পিছনের দিকে তাকালে চলবে না।  নতুন দিনের  জয়ের পথে সবাইকে নিয়ে সবাই এগিয়ে চলতে হবে।  যারা নতুন দিনের মানুষ তাদের চোখেই ফুটে উঠবে সফলতার আলো।  আর তাদের সফলতার মধ্য দিয়ে আসবে নতুন দিনের সূর্য।  নতুন পৃথিবী সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছে।  



জীবনভিক্ষা - করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়

 কবিতার সারাংশ :

কিসা গৌতমীর একমাত্র শিশুপুত্রটি মারা গিয়েছে।  শিশুপুত্রের মৃত্যুতে সে পাগলপ্রায়। পুত্রের মৃতদেহ নিয়ে   মন্দিরে মন্দিরে সে তার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রের জীবনের জন্য ঘুরে বেড়াল।  কিন্তু ব্যর্থ হল।  আপন জীবন দিতেও সে প্রস্তুত ছিল পুত্রের জীবনের জন্য।  তার দুধের বাছা চোখ মেলল না।  অবশেষে সে  পরমপুরুষ  গৌতম বুদ্ধের কাছে গেল।বুদ্ধদেব সমগ্র পৃথিবীর " ত্রিতাপ দুঃখ " ( অর্থাৎ আধ্যাত্মিক , আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক ) হরণ করেছেন। সেইজগতদুর্লভ  জীবের দুঃখহারী বুদ্ধদেবকে তার  পুত্রের জীবন ফিরিয়ে দিতে প্রার্থনা জানাল।  গৌতম বুদ্ধ বললেন ,তার পুত্র " নীরব সমাধি মগ্ন " , সে চিরসুন্দর মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছে।  এমন যদি কোনো ঘর থেকে থাকে যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করেনি , তবে সেখান থেকে কিছুটা সর্ষে নিয়ে এলে তার স্পর্শে পুত্রটি প্রাণ ফিরে পাবে।কিসা গৌতমী দরজায় দরজায় ঘুরে বেড়াল , কিন্তু একটি ঘরও পেল না যেখানে মৃত্যু প্রবেশ করেনি।  ফিরে এল সে গৌতম বুদ্ধের কাছে।  জানাল, তার মোহ -বিরহ তিরহিত।  সে বুঝেছে যে মৃত্যু জীবন মাত্রেই আছে , মৃত্যুকে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।  মৃতের প্রাণ ফেরানোর চেষ্টা তাই বৃথা।  সে তার মৃত পুত্রের জীবন চায় না।  জগতের বিরহ দুঃখ হরণকারী বুদ্ধদেব তাকে যেন "অমৃত দীক্ষা" দেন।  



  

আগামী



"আগামী" 

কবি - সুকান্ত ভট্টাচার্য 
 কবিতার সারাংশ
আজ যে বীজ অংকুরিত  , সে চিরকাল চারাগাছটি থাকবে না ।তার মধ্যে রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা। আপন শক্তি ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তার আত্মবিশ্বাসও যথেষ্ঠ রয়েছে । বৃহতের আহ্বানে সে চোখ মেলে তাকিয়েছে।
অনেক বড় কিছু করবার পরিকল্পনা আছে তার । সে  আজ দুর্বল ও নগণ্য;  তাই বলে সে অবহেলার পাত্র নয়। একদিন সেও মহীরূহে পরিণত হবে। ধীরে ধীরে সে বিকশিত হবে। পাতা মেলবে, মাথা নাড়বে, শাখা ছড়াবে।  প্রতিবেশী গাছদের সামনে ফুল ফোটাবে। আত্মশক্তিতে সে সম্পূর্ণ বলবান হবে। ঝড়ের আঘাত হার মানবে তার কাছে। নবজাতকের দলকেও সে আহ্বান জানাবে --বলবে এগিয়ে আসতে।  অনতিকাল পরে, হয়তো আগামী বসন্তেই সে মহীরুহদের দলে মিশে যাবে।  তখন অন্যরা তার জয়ধ্বনি করবে। সে যখন সম্পূর্ণরূপে আত্মবিকাশ করবে , তখন মানুষ হয়তো তার অঙ্গচ্ছেদন করবে। কিন্তু তবু সে তাদের ছায়া দানে , ফল দানে , পাখির কূজন দানে বঞ্চিত করবে না।  কারণ সে সবার কাছে তাদের আপনজন হয়ে থাকতে চায়।  




সওগাত

 সওগাত 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর 

 মনে রাখার বিষয় :  

    • "সওগাত" গল্পটি  " লিপিকা" কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া হয়েছে।  
    • "সওগাত " কথাটির অর্থ হল " উপঢৌকন "
    • "সওগাত " কথাটি একটি ফারসী শব্দ। 
শরৎ কাল প্রিয় সম্মিলনের ঋতু।  এই সময় প্রবাসী ( প্রবাসী অর্থাৎ যারা কর্মসূত্রে বা অন্য কোন কারণে দেশ ছেড়ে দূরে থাকে )  চায় নিজের ঘরে ফিরতে। মা দুর্গা যেমন এই সময় তাঁর মার কাছে ফিরে আসেন , তেমনই সবাই চায় তার মায়ের কাছে ফিরে আসতে।  পুজোর গন্ধর সঙ্গে মায়ের গন্ধ মিশে থাকে। তাই "রবীন্দ্রনাথের " মনে পড়া " কবিতাতে পুজোর গন্ধ মায়ের গন্ধ হয়ে যায়।  
             গল্পের শুরুতে দেখা যায় পুজোর সময়েও বাড়ির ছেলেরা সবাই মায়ের থেকে দূরে রয়েছে।  একমাত্র মায়ের কোলের ছেলেটি মায়ের কাছে আছে।  মা তার সেই দূরে থাকা ছেলেদের জন্য , কুটুম্বদের জন্য নানা উপঢৌকন পাঠাচ্ছেন।  বেনারসী কাপড়, সোনার অলঙ্কার , ভান্ড  ভরে ক্ষীর দই, পাত্র ভরে মিষ্টান্ন। মায়ের থেকে দূরে থাকা ছেলেরা মায়ের স্নেহের বদলে রাশীকৃত জিনিস পেয়েছে যা অর্থমূল্যে অতি সহজেই কিনতে পাওয়া যায়।  ছোটছেলেটি উপঢৌকনের বাইরের চাকচিক্য দেখে আকর্ষিত হয়ে মার কাছে গিয়ে অনুযোগ জানাচ্ছে। মা তখন সবথেকে মূল্যবান উপহার "মায়ের স্নেহচুম্বন  "  শুধু ছোট ছেলেটিকে দেয়।  মায়ের স্নেহ যা শুধুমাত্র মায়ের কাছেই পাওয়া যায়।  
            এই হচ্ছে মায়ের দেওয়া সেরা " সওগাত " তার সন্তান কে।  



( উৎসাহী ছাত্রছাত্রীদের জন্য : 
 .সুন্দর রঙবেরঙের ঢাকা দেওয়া সওগাত গুলি দেখে .ছেলেটির মন  উৎসুক হয়ে উঠেছিল    অথচ মায়ের হৃদয়ের দানের তুলনায় তাঁর এই পুজোর পরবের দান  যে কত মূল্যহীন তা  বোঝানোর জন্য সব সওগাত চলে যাওয়ার পর দিনান্তের অসামান্য একটি সাংকেতিক রূপকল্প সৃষ্টি হয়েছে : 
"দিনের শেষ নৈবেদ্যের সোনার ডালি নিয়ে সূর্যাস্তের শেষ আভা নক্ষত্রলোকের পথে নিরুদ্দেশ হল " 

সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় যে মায়াবী আলোর ও দৃশ্যের সৃষ্টি হয় তা অত্যন্ত সাময়িক।  কিছু সময় পরেই তা বিলীন হয়ে যায়।  সেই রকম মায়ের পাঠানো দামী ও সুন্দর দ্রব্যগুলি একদিন শেষ হয়ে যাবে রয়ে যাবে শুধু মায়ের স্নেহ , মায়ের আদর যা একমাত্র পেল মায়ের কাছে থাকা  কোলের ছেলেটি।  ) 



তোতাকাহিনী (সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা )

 সপ্রসঙ্গ ব্যাখ্যা : 

(১) " সে গান গাহিত , শাস্ত্র পড়িত না " 

প্রসঙ্গ : 

 যে পাখিটির করুণ কাহিনি  লেখক লিপিবদ্ধ করতে চলেছেন , সেই তোতাপাখিটির স্বভাব -বৈশিষ্ট্য বর্ণনা প্রসঙ্গে তিনি আলোচ্য কথাটি বলেন।  

সরলার্থ : 

তোতাপাখিটি সর্বক্ষণ লাফাত , উড়ত , গান গাইত।  কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়ত না, সামাজিক কোনো রীতিনীতিরও ধার ধারত না।  সে ছিল " মূর্খ ". বনের মধ্যে নিজের খেয়ালখুশি মতোই জীবন কাটাত।  

তাৎপর্য : 

মানবশিশুর জীবনও স্বাধীন তোতাপাখির মতো।  হাঁটতে চলতে এবং কথা বলতে শেখার পরই তাই সে মনের খুশিতে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ায়।  নিজের আনন্দেই কথা বলে ও গান গায়।  সমাজের রীতিনীতি সে বোঝে না , বুঝতেও চায় না, এমনকি লেখাপড়াও করে না।  সর্বক্ষণই প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর থাকে সে।  

(২) এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান ঘটায়। " 

প্রসঙ্গ : 

আলোচ্য রচনায় যে পাখিটির করুণ পরিণতি দেখানো হয়েছে , সেই তোতাপাখিটি সম্পর্কে রাজার মনোভাব ব্যক্ত করতে গিয়ে তাঁরই জবানিতে স্বয়ং লেখক উল্লিখিত উক্তিটি করেছেন। 

সরলার্থ :

বনের তোতাপাখিটি মনের আনন্দেই বনের ফল খেত।  ফলে ফলের ব্যাবসায় রাজার ক্ষতি হত।  পাখিটি তাঁর কোন কাজেই লাগত না।  ব্যবসা বুদ্ধিসম্পন্ন রাজার কাছে তাই তোতাপাখিটি ছিল এক মূর্তিমান লোকসান।  

তাৎপর্য : 

এ গল্পের রাজা পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণির প্রতিভূ।  এই শাসকশ্রেণি তাদের শ্রেণিগত লাভ-লোকসানের নিরিখেই বিচার করে জনগণ এবং জনগণের কাজকর্ম ও চিন্তাভাবনাকে।  শাসকশ্রেণির স্বার্থবিরোধী মানুষ তাদের চোখে ক্ষতিকারক ও অপ্রয়োজনীয়।  

(৩) " পাখিটাকে শিক্ষা দাও " 

প্রসঙ্গ : 

মূর্খ পাখিটা সবসময় আপন খেয়াল খুশিতে লাফাত, উড়ত, গান গাইত।  কোনো ধর্মগ্রন্থ পড়ত না , সামাজিক কোনো রীতিনীতিরও ধার ধারত না সে।  রাজার চোখে এমন পাখি অকাজের।  তা ছাড়া বনের ফল খেয়ে সে তাঁর ফলের ব্যবসাতেও ক্ষতি করে।  তাই মন্ত্রীকে তিনি এমন আদেশ দিয়েছেন।  

সরলার্থ :

পাখির সহজ প্রাণচাঞ্চল্যকে অনিয়ম ও অভব্যতা বলে মনে হয়েছিল বস্তুবাদী রাজার।  তাই সমাজের যান্ত্রিক নিয়মের ছাঁচে ফেলে তাকে শিক্ষিত ও পরিণত করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি।  

তাৎপর্য : 

পুঁজিবাদী শাসকশ্রেণি , এমনকি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিশুর পিতামাতাও শিশুদের সহজ আনন্দের প্রকৃতিপাঠে আগ্রহী নন।  তবে তাঁরা উভয়েই শিশুকে শিক্ষা দিতে চান।  শাসকশ্রেণি শিশুকে দিতে চায় কেরানি হয়ে ওঠার উপযোগী শিক্ষা এবং শাসকশ্রেণির বিরোধিতার উপযুক্ত শাস্তি।  জৈবিকতা থেকে মানবিকতায় উত্তরণের শিক্ষা এ নয়।  


(৪) "  শিক্ষার একেবারে হদ্দমুদ্দ" 

প্রসঙ্গ : 

পাখির জন্য তৈরি সোনার খাঁচাটির কারুকার্যে  আকৃষ্ট হয়ে দেশ- বিদেশ থেকে দলে দলে লোক আসতে শুরু করেছিল।  তাদের মধ্যে কেউই ভাবতে পারেনি যে, সামান্য পাখির শিক্ষার জন্য বিপুল অর্থব্যয়ে এমন এক অভিনব খাঁচা বানানো যেতে পারে।  তাই আগন্তুক দর্শনার্থীদের একজন খাঁচা দেখে বিস্মিত হয়ে উক্তিটি করেছিলেন।  

সরলার্থ : 

"হদ্দমুদ্দ " কথাটির অর্থ হল চরম বা চূড়ান্ত বা একশেষ।  প্রকৃতপক্ষে , একটি তোতাপাখির শিক্ষার জন্য যে এমন অসাধারণ সোনার খাঁচা তৈরি করা যেতে পারে , তা ভাবতেই পারেনি কেউ।  আশ্চর্য ও অভিভূত হয়ে বক্তা তাই জানিয়েছেন যে , খাঁচাটি শিক্ষাব্যবস্থার একেবারে চূড়ান্ত নিদর্শন। 

তাৎপর্য : 

বক্তা এখানে সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি। ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যানিকেতনের অলংকরণ ও বিশালতাই সাধারণ মানুষকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল।  কিন্তু তারা এ কথা বুঝতে পারেনি যে , চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি করে শিক্ষার্থীর শরীর-মনের সার্থক বিকাশ ঘটানো সম্ভব নয়।   


(৫) "অল্প পুঁথির কর্ম নয় " 

প্রসঙ্গ : 

অত্যাশ্চর্য সোনার খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিটিকে পন্ডিত যখন শিক্ষা দিতে বসলেন তখন তিনি পুঁথির অপ্রতুলতা অনুভব করলেন।  নাকে নস্যি নিয়ে প্রথমেই তিনি পুঁথির অপ্রতুলতা অনুভব করলেন।  নাকে নস্যি নিয়ে প্রথমেই তিনি প্রশ্নে উল্লিখিত অভিমতটি প্রকাশ করেন।  

সরলার্থ : 

পুঁথি বলতে আমরা মুদ্রণ-পূর্ব -যুগের হাতে-লেখা গ্রন্থকেই বুঝি।  আলোচ্য গদ্যে পন্ডিত মনে করেছিলেন যে , পাখিটিকে যথার্থভাবে শিক্ষিত করে তুলতে রাশি রাশি পুঁথির প্রয়োজন।  যত বেশি-সংখ্যক পুঁথি পাখিকে পড়ানো হবে সে তত বেশি শিক্ষিত হবে।  

তাৎপর্য :

ইংরেজপ্ৰবৰ্তিত আধুনিক শিশুশিক্ষার  অন্যতম বৈশিষ্ট হল শুকনো তথ্যসমৃদ্ধ পাঠ্যগ্রন্থের সংখ্যাধিক্য।  শিক্ষকেরা করতেন যে , ছাত্ররা যত বেশি-সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পড়বে , তাদের বিদ্যার পরিমাণ ততই বৃদ্ধি পাবে।  তাঁরা ভেবে দেখেন নি যে , পাঠ্যপুস্তকের পাহাড়প্রমাণ চাপ  কেবল শিক্ষার্থীর চিন্তা চেতনার বিকাশই রুদ্ধ হয় না , তার স্বকীয়তা নষ্ট হয়।  


(৬) "শাবাস ! বিদ্যা আর ধরে না ! " 

প্রসঙ্গ : 

সোনার খাঁচায় বন্দি তোতাপাখিটিকে শিক্ষা দিতে গিয়ে পন্ডিত উপদেশ দিয়েছিলেন পুঁথির সংখ্যা বাড়ানোর।  লিপিকররা বিভিন্ন পুঁথির অনুলিপি এবং অনুলিপির অনুলিপি করে তৈরি করলেন পাহাড়প্রমাণ পুঁথি এসব দেখেই প্রশংসাবাক্যটি উচ্চারিত হয়েছিল।  

সরলার্থ : 

তোতাপাখীটিকে যথার্থভাবে শিক্ষিত করতে প্রয়োজন প্রভূত পুঁথির , কারণ যত বেশি পুঁথি পড়বে পাখি, তত বেশি শিক্ষিত হবে সে।  পন্ডিতের এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে দর্শনার্থীরা একমত ছিলেন বলে পাখির শিক্ষায় বরাদ্দ পুঁথির পরিমাণ দেখে তাঁরা অত্যন্ত খুশি হয়েছিলেন।  

তাৎপর্য : 

ইংরেজ প্রবর্তিত আধুনিক শিশুশিক্ষার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল পাঠ্যপুস্তকের আধিক্য।  সাধারণ মানুষও মনে করতেন যে শিক্ষার্থীরা যত বেশি সংখ্যক পাঠ্যপুস্তক পড়বে , তারা ততই বিদ্বান হবে।  তাঁরা ভাবেন নি যে, পাঠ্যপুস্তকের প্রবল চাপে  শিক্ষার্থীর চিন্তাচেতনার বিকাশই রুদ্ধ হয় না, তার স্বকীয়তাও বিনষ্ট হয়।  




তোতাকাহিনী





 সার - সংক্ষেপ : 

রবীন্দ্রনাথের " লিপিকা" গ্রন্থের অন্তর্গত " তোতাকাহিনী" একটি রূপকধর্মী রচনা। ব্যঙ্গে - কটাক্ষে পূর্ন এই রচনায় আছে একটি তোতাপাখিকে শিক্ষিত করা তোলার বিবরণ।  

                         এক মূর্খ তোতাপাখি ছিল।  সে গান গাইত , লাফাত , উড়ত কিন্তু শাস্ত্র পড়ত না।  কায়দাকানুন কাকে বলে তাও  জানত না।  পাখিকে অত্যন্ত অকেজো মনে হল রাজার। তাই তিনি তাকে শিক্ষা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন।  শিক্ষিত করে তোলার দায়িত্ব পড়ল রাজার ভাগ্নেদের ওপর।  ভাগ্নেরা শিক্ষার আয়োজনে কোনো  ত্রূটি রাখল না।  বড়ো বড়ো পন্ডিতদের আনা হল।  স্যাকরাদের দিয়ে বানানো হল সুদৃশ্য সোনার খাঁচা।  লিপিকরদের দিয়ে নকল করানো হল রাশি রাশি পুঁথি।  বহু লোক পাখিটির শিক্ষা সংক্রান্ত কোন না কোন কাজে  যুক্ত হয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে লাগল।  একসময় নিন্দুকদের মুখ থেকে খবর রটল , খাঁচার উন্নতি হচ্ছে ঠিকই , কিন্তু পাখিটার খবর কেউ রাখে না।  রাজা শুনে ভাগ্নের কাছে সব জানতে চাইলে ভাগ্নে তাঁকে সন্তোষজনক জবাব দিল।  শিক্ষা কেমন চলছে দেখার জন্য রাজা স্বয়ং একদিন শিক্ষাশালায় উপস্থিত হলেন।  বিপুল আয়োজন করে রাজাকে অভ্যর্থনা  জানানো হল।  খুশি হয়ে রাজা পাখিটিকে না দেখেই চলে যাচ্ছিলেন , কিন্তু নিন্দুকের কথায় আবার ফিরে এলেন।  তিনি দেখলেন পাখিটাকে দানাপানি দেওয়া বন্ধ হয়েছে , কেবল রাশি রাশি পুঁথির পাতা কলম দিয়ে তার মুখে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে।  গান তো বন্ধই , চিৎকার করার ও জো নেই।  রাজা দেখেশুনে খুশি হলেন।  এদিকে দিনে দিনে আধমরা পাখিটা খাঁচার বাইরে যাওয়ার জন্য ছটপট করতে থাকলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হল।  এইভাবেই একদিন মৃত্যু হল পাখিটার।  কিন্তু কেউ টের পায়নি।  নিন্দুকের কথা কানে যাওয়ায় রাজার নির্দেশে পাখিটাকে আনা হল।  রাজা পাখিটাকে টিপলেন কিন্তু " সে হাঁ করিল না , হুঁ করিল না।  কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল। " 

          তোতাপাখির এই কাহিনির  মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত  ভারতের শিক্ষাব্যবস্থাকে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গে বিদ্ধ করেছেন।  তিনি দেখাতে চেয়েছেন , শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষার উপকরণ ও পদ্ধতিকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়  , তাতে প্রকৃত শিক্ষা কিছুই হয় না।  শিক্ষাকে উপলক্ষ করে খরচ হয় রাশি রাশি অর্থ , চোখ ধাঁধিয়ে যায় আয়োজনের আড়ম্বরে ; কিন্তু যার জন্য শিক্ষা , সেই শিক্ষার্থীর খোঁজ নেওয়া হয় না।  উপকরণ ও পদ্ধতির চাপে নষ্ট হয় তার প্রাণশক্তি।  উপকরণসর্বস্ব শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে কী সাংঘাতিক ফাঁকি রয়েছে , লেখক এখানে তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। 


পোস্টমাস্টার

প্রশ্ন ও উত্তর    (১) ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ?  উত্তরঃ  ' পোস্টমাস্টার' গল্পটি 'হিতবাদী' পত...