' বামা' গল্পে গুরুদেবের প্রসঙ্গ
বাঙালি ধর্মভীরু জাতি। বিশ্ব সংসারের সবকিছুকেই সে ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত করে। শিক্ষা , সংসারের সমৃদ্ধি বা নিজের প্রাণ সবকিছুকেই সে ঈশ্বরের দান মনে করে। আর এই ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে সে 'গুরু'কে নিজের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ মনে করে। কখনো সে শিক্ষাগুরু আবার কখনো সে ধর্মগুরু। 'শিক্ষাগুরু'র বিভিন্নরূপ আমরা বাংলা সাহিত্যে অনেক পাই। যেমন রবীন্দ্রনাথের 'মাস্টারমশাই ', 'অচলায়তন ','গিন্নি' ; বনফুলের 'যোগেন পন্ডিত' , নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের 'দাম' গল্পে। ধর্মগুরুর বিভিন্ন রূপ দেখতে পাই শরৎচন্দ্রের 'লালু ' , পরশুরামের ' বিরিঞ্চিবাবা' গল্পে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'গিন্নি' গল্পে 'শিক্ষাগুরু'র উল্লেখ আমরা গল্পের প্রথমেই দেখতে পাই। গল্পকথক আমাদের জানান তার স্কুলে ছাত্রবৃত্তি ক্লাশের দুই তিন শ্রেণি নীচে তাদের শিক্ষক ছিলেন শিবনাথ পন্ডিত। শিবনাথ পন্ডিতের চেহারা বা ছাত্রদের প্রতি তাঁর ব্যবহারের যে বর্ণনা গল্পকথক দিয়েছেন তার কোনটাই তেমন সুখবর নয় , বিশেষভাবে ছাত্রদের তিনি যেভাবে শাসন করতেন। কথায় আছে " শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে। " শিবনাথ পন্ডিতের চরিত্রে ছাত্রদের প্রতি স্নেহের প্রকাশ কখনোই দেখা যায় না। গল্পকথক বলেছেন শিবনাথ পন্ডিতের "কিল চড়চাপড় চারাগাছের বাগানের উপর শিলাবৃষ্টির মতো " যেমন অজস্র বর্ষিত হাত তেমনই তাঁর 'তীব্র বাক্যজ্বালায় ' প্রাণ বের হয়ে যেত। ছাত্রদের কষ্ট দেওয়ার আর একটি নতুন ও অভিনব অস্ত্র তাঁর ছিল। তিনি ছাত্রদের চেহারা বা কিছু কাজ অনুযায়ী তাদের অত্যন্ত অপমানজনক নামকরণ করতেন। তার ফলে ছাত্রটি সবার কাছে অত্যন্ত ব্যঙ্গের শিকার হত। যেমন হয়েছিল আশু। সে নিতান্ত বেচারা ভালোমানুষ ও লাজুক ছাত্র ছিল। সে তার ব্যক্তিগত জীবন সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতেই পছন্দ করত। কিন্তু শিবনাথ পন্ডিত একদিন ঘটনাক্রমে জানতে পারেন যে আশু তার ছোটবোনের সঙ্গে ' পুতুলের বিয়ে ' খেলছিল। ছোটবোনের একদিনের সেই নিরীহ খেলার জন্য আশুকে তিনি নামকরণ করেন 'গিন্নি' কারণ তাঁর কাছে 'পুতুলের বিয়ে' খেলা 'মেয়েলি' ও 'হাস্যকর '। তিনি একবার ও ভাবলেন না এই নামকরণের ফলে একটি ছোটছেলের মন কতখানি আহত ও বিপর্যস্ত হল। 'শিক্ষাগুরু' হিসেবে শিবনাথ পন্ডিত আমাদের কাছে শ্রদ্ধার আসন বিচ্যুত হলেন।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত 'লালু' গল্পে আমরা যে গুরুদেবের সাক্ষাৎ পাই। তিনি যদিও সংসার ত্যাগ করে ভগবানের সাধনা করার জন্য আশ্রমে থাকেন তবুও তিনি যখন শিষ্যার বাড়িতে আসেন তখন তাঁর জাগতিক সুখ ভোগের দিকেই বেশি লক্ষ্য থাকে। গুরুদেব একজন অত্যন্ত সাধারণ ও আরামপ্রিয় মানুষ। কিন্তু লালুর মা অন্ধভক্তি দ্বারা তাকে দেবত্বে উন্নীত করতে চেয়েছিলেন। লালু দুষ্টুমি করে গুরুদেব ও মাকে জব্দ করতে চেয়েছিল কিন্তু গুরুদেবের রাতভোর যে দুর্ভোগ হয় তার মাধ্যমে লেখক হয়তো বলতে চেয়েছেন অন্ধভক্তি যখন মানুষের বোধবুদ্ধিকে ভোঁতা করে দেয় তখন মানুষের জীবনেও নেমে আসে দুর্ভোগ।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত 'বামা' গল্পে আমরা আবার আর এক 'ঠাকুরমশাই' এর সাক্ষাৎ পাই। তিনি নিজে দৈব মাদুলি ও ঔষধ বিক্রয় করেন কিন্তু নিজের বিপদের সময় দৈবে ঠিক ভরসা রাখতে পারেন না। বরং এক বুদ্ধিমতী গৃহবধূর উপস্থিত বুদ্ধিতে বিপদ থেকে উদ্ধার পান। ঠাকুরমশাই তাঁর জীবনদাত্রী গৃহবধূ বামাকে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
No comments:
Post a Comment