রবীন্দ্রনাথের প্রতি
বুদ্ধদেব বসু
তোমারে স্মরণ করি আজ এই দারুন দুর্দিনে
হে বন্ধু , হে প্রিয়তম। সভ্যতার শ্মশান - শয্যায়
সংক্ৰমিত মহামারী মানুষের মর্মে ও মজ্জায় ;
প্রাণলক্ষ্মী নির্বাসিতা। রক্তপায়ী উদ্ধত সঙিনে
সুন্দরেরে বিদ্ধ ক'রে , মৃত্যুবহ পুষ্পকে উড্ডীন
বর্বর রাক্ষস হাঁকে , ' আমি শ্রেষ্ঠ , সবচেয়ে বড়ো। '
দেশে দেশে সমুদ্রের তীরে কাঁপে থরোথরো
উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ।
প্রাণ রুদ্ধ , প্রাণ স্তব্ধ। ভারতের স্নিগ্ধ উপকূলে
লুব্ধতার লালা ঝরে। এত দুঃখ, এ দুঃসহ ঘৃণা --
এ-নরক সহিতে কি পারিতাম , হে বন্ধু , যদি না
লিপ্ত হ'তো রক্তে মোর , বিদ্ধ হ'তো গূঢ় মর্মমূলে
তোমার অক্ষয় মন্ত্র। অন্তরে লভেছি তব বাণী
তাই তো মানি না ভয় , জীবনেরই জয় হবে , জানি।
বিষয় সংক্ষেপ :
আধুনিক বাংলা কাব্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ
বুদ্ধদেব বসু। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের বছর লেখা হয় "রবীন্দ্রনাথের প্রতি"।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে বিশ্বব্যাপী যে অনিশ্চয়তা -তার আঁচে প্রতিটি বিবেকী মানুষ দগ্ধ হয়েছে। মন হয়েছে অস্থির। এই চঞ্চলতার মুহূর্তে কবি স্মরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথকে ------
" তোমাকে স্মরণ করি আজ এই দারুণ দুর্দিনে
হে বন্ধু , হে প্রিয়তম ,"
শুধু স্মরণ নয় , তাঁকে 'বন্ধু' এবং ' প্রিয়তম ' রূপে সম্বোধনে বোঝা যায় কবির অন্তরের কতখানি জায়গা জুড়ে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বযুদ্ধ বহু মানুষকে শুইয়েছে শেষ শয্যায়। মন্বন্তর , মহামারী মানুষের অন্তরকেও দিয়েছে একেবারে নিঃস্ব করে। এই সর্ব নিঃস্বতার পরিবেশে সুন্দরের কোনও স্থান নেই। সে প্রতি মুহূর্তে বিদ্ধ হচ্ছে রক্তপায়ী মানুষজনের উদ্যত সঙ্গিনে। যে আকাশ ছিল মুক্তির প্রতীক , যেখানে রামায়ণের কালে শ্রী রামচন্দ্রের বাহন পুষ্পক বিহার করত জীবনের জয়গান গাইতে গাইতে - সেই আকাশ এখন দখল করেছে
মৃত্যুবাহী যুদ্ধ বিমান। কবি আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন সেই মৃত্যুদূত স্বরূপ সর্বগ্রাসী রাক্ষসদের তান্ডবে। তারা প্রমাণ করতে চায় তারা সবচেয়ে বড় - 'আমি শ্রেষ্ঠ , সবচেয়ে বড়ো'।
তাদের দাপটে ,---
" দেশে দেশে সমুদ্রের তীরে তীরে কাঁপে থরো থরো
উন্মত্ত জন্তুর মুখে জীবনের সোনার হরিণ। "
লক্ষণীয় সে সময় জাপানী আক্রমণ অত্যন্ত তীব্র হয়েছে, হিটলার অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে চরম সিদ্ধির লক্ষ্যে --- ফলে সাধারণ মানুষের অবস্থা হয়েছে উন্মত্ত জন্তুর মুখে হরিণের মতো অসহায়।
যে ভারতবর্ষ এককালে সারা পৃথিবীতে সন্ধান দিয়েছে মৃত্যুজয়ী অমৃতের সেই ভারতবর্ষে শক্তিমানের নিষ্ঠূরতায় ,
শোষকের শোষণে ও রক্তচক্ষু প্রদর্শনে প্রাণের প্রবাহ গিয়েছে রুদ্ধ হয়ে , জীবন হয়ে উঠেছে বিষময় , প্রাণ রুদ্ধ। এর কারণ শোষকের শোষণ বাসনা অতি তীব্র। দীর্ঘকাল ধরে চলেছে এই শোষণ। কিন্তু বিংশ শতকের প্রথমার্ধে ও শোষণের ভয়াবহ রূপ দেখে ব্যথিত হয়ে উঠেছেন কবি। কবি তাই বলেছেন, -----
" এত দুঃখ, এ দুঃসহ ঘৃণা ----
এ-নরক সহিতে কি পারিতাম , হে বন্ধু যদি না
লিপ্ত হ'তো রক্তে মোর , বিদ্ধ হ'তো গৃঢ় মর্মমূলে
তোমার অক্ষয় মন্ত্র। "
কবি বুঝেছেন তাঁর এই সহ্যশক্তির মূলে রয়েছে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাসের অমোঘমন্ত্র। তাঁর পরিবেশিত জীবনের অমৃত শক্তি আনন্দবাদী রবীন্দ্রনাথ সংশয়ী কবির মনে জায়গা করে নিয়েছেন। এই সর্বনষ্ট জগতের বুকে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করেন নি কবি। তিনি জানেন শেষ পর্যন্ত " জীবনের জয় " হবে। এই অস্তি চেতনা , এই আনন্দবাদী অনুভব বুদ্ধদেবকে রবীন্দ্রনাথের কাছাকাছি এনেছে।
No comments:
Post a Comment