প্রশ্ন ও উত্তর
(১) " খেয়ানৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে "
- পংক্তিটির উৎস লিখে নৌকার কাজের বর্ননা দাও।
উত্তরঃ
প্রশ্নে উল্লিখিত পংক্তিটির উৎস হল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চৈতালী 'কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত 'খেয়া ' কবিতা।
নদী পারাপারের মাধ্যম হল খেয়া তরি । কর্মসূত্রে বা অন্য প্রয়োজনে এক গ্রামের মানুষকে নদী পার হয়ে অন্য গ্রামে যেতেই হয় , তখনই তাদের প্রয়োজন হয় খেয়া তরির। নদী পারাপারের সূত্রকে কেন্দ্র করেই এই খেয়া নৌকা দুই গ্রামের মানুষকে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। নদীকূলবর্তী দুই গ্রামের মানুষের প্রাত্যহিক জীবন 'খেয়া নৌকা'র মাধ্যমে এভাবেই আবর্তিত হয়।
(২) " খেয়ানৌকা পারাপার করে নদীস্রোতে "
-- নদীস্রোতের প্রসঙ্গের মাধ্যমে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন ?
উত্তরঃ
খেয়া নৌকার মাধ্যমে নদীর দুই পারের মানুষ আপন আপন প্রয়োজনে এক পার থেকে পরপারে যাওয়া-আসা করে। কেউ কর্মের তাগিদে বাড়ি থেকে বাইরে যায় আবার কেউ-বা বাইরে থেকে ঘরে ফেরে। আবহমানকাল ধরে যেমন নদী প্রবহমান , তেমনই মানুষের কর্মস্রোতও অনন্তকাল ধরেই চলে আসছে। নদীবক্ষে বয়ে চলা খেয়া নৌকা মানবজীবনের শাশ্বত বহমানতাকেই প্রকাশ করছে। কবি নদী স্রোতের মাধ্যমে জীবনের এই সত্যকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন।
(৩) " কেহ যায় ঘরে , কেহ আসে ঘর হতে "
--- 'কেহ ' বলতে কাদের কথা বলা হয়েছে ? তারা কীভাবে যাওয়া -আসা করে ?
উত্তরঃ
প্রশ্নের এই অংশটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'খেয়া ' কবিতা থেকে নেওয়া হয়েছে। এখানে নদীর দুই পারে অবস্থিত গ্রামের মানুষদের 'কেহ ' বলা হয়েছে , যারা খেয়া নৌকায় নদী পারাপার হয়।
খেয়া নৌকার মাধ্যমে নদীর দুই তীরের মানুষ নিত্য যাওয়া -আসা করে। কেউ কর্মের তাগিদে বাড়ি থেকে বাইরে যায় , আবার কেউ বা কাজ শেষে বাড়ি ফেরে ওই খেয়া নৌকায় সওয়ার হয়ে। নদীর মতোই মানুষের এই যাওয়া -আসা প্রবহমান , যার মাধ্যম হল খেয়া তরি।
(৪) " নূতন নূতন কত গড়ে ইতিহাস "
--- কোন প্রসঙ্গে এই উক্তি ? কীভাবে নতুন ইতিহাস গড়ে ওঠে ?
উত্তরঃ
কবি মানব -ইতিহাসের সংঘাত , ধ্বংস ও সৃষ্টির চিরসত্যতা প্রসঙ্গেই 'খেয়া ' কবিতায় আলোচ্য উক্তিটি করেছেন।
কবি উপলব্ধি করেছেন অহংবোধ , ক্ষমতার লোভ , হিংসার বশবর্তী হয়ে শক্তিরাষ্ট্রগুলি পারস্পরিক দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয় বারংবার। ফলে একটি সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় আবার সেই ধবংসস্তূপের ওপরেই স্থাপিত হয় নতুন সাম্রাজ্য। আবহমানকাল ধরেই এভাবে সাম্রাজ্যের ভাঙাগড়া চলে আসছে। এই গড়ার মাধ্যমেই রচিত হয় নতুন এক ইতিহাস।
(৫) " পৃথিবীতে কত দ্বন্দ্ব , কত সর্বনাশ "
---- এই দ্বন্দ্ব -সংঘাতের কারণ কী ? এর পরিনাম কী ?
উত্তরঃ
আবহমানকাল ধরে পৃথিবীতে মানব -ইতিহাস কলঙ্কিত হচ্ছে দ্বন্দ্ব সংঘাত ও পারস্পরিক যুদ্ধের কারণে। শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রকে দখল করার চেষ্টায় রত। ক্ষমতার লোভ , অহংবোধ , হিংসাই হল দ্বন্দ্ব সংঘাতের মূল কারণ। পাশবিক স্বার্থপরতার কারণেই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে তথা মানুষে মানুষে দ্বন্দ্ব -সংঘাত সংগঠিত হয়।
দ্বন্দ্ব -সংঘাতের ফলেই রক্তাক্ত হয় মানব -ইতিহাস। দুর্বল শোষিত ও পরাধীন জাতিতে পরিণত হয়। এই দ্বন্দ্বের ফলেই সৃষ্টি হয় যুদ্ধ তাতে ধ্বংস হয় এক সাম্রাজ্য , আবার গড়ে ওঠে নতুন এক সাম্রাজ্য।
(৬) " সোনার মুকুট কত ফুটে আর টুটে"
----- কোথায় ,কীভাবে এমন ঘটনা ঘটে ?
উত্তরঃ
----- পৃথিবীতে যেখানে মানবসভ্যতার বিজয়রথ এগিয়ে চলেছে সেখানেই 'সোনার মুকুট ' ফুটে আর টুটে।
সুখ- দুঃখ আনন্দ বেদনাময় পৃথিবীতে দ্বন্দ্ব সংঘাত লেগেই আছে। এখানেই রচিত হয় সভ্যতার ইতিহাস। ক্ষমতার দম্ভে শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রকে পেশি শক্তি প্রয়োগ করে নিজের ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে। জয় -পরাজয় , সিংহাসন , স্বর্ণ মুকুট এই সবই রাজাদের জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাধারণ মানুষ এই সবের থেকে দূরে থাকে। তারা তাদের দৈনন্দিন সাধারণ জীবন শান্তিপূর্ণ ভাবে কাটিয়ে দেয়। এক রাজা সিংহাসনে বসে ,চলে যায় , অন্য রাজা আবার সিংহাসনে বসে। কিন্তু সাধারণ মানুষ তাদের নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকে। এই ভাবেই পৃথিবী আবহমানকাল ধরেই চলে।
(৭) " রক্তপ্রবাহের মাঝে ফেনাইয়া উঠে "
---- 'রক্তপ্রবাহ ' বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন ? এখানে 'ফেনাইয়া ' শব্দ ব্যবহারের গুরুত্ব কী ?
উত্তরঃ
'রক্তপ্রবাহ ' বলতে রক্তস্রোতের কথাই বলা হয়েছে। সভ্যতার ইতিহাস হল রক্তাক্ত ইতিহাস। অধিক শক্তিধর রাষ্ট্র নিজেদের পেশিশক্তির মাধ্যমে দুর্বল রাষ্ট্রের স্বাধীনতা হরণ করে। এর জন্য যুদ্ধ হয় , রক্তস্রোত বয়। এই রক্তস্রোতকেই কবি 'রক্তপ্রবাহ ' বলেছেন।
' ফেনা' অস্থায়ী। সৃষ্টির ক্ষণকালের মধ্যেই বুদ্বুদের মতো তার বিনাশ ঘটে। অশুভ শক্তির গর্বোদ্ধত আচরণও সভ্যতার ইতিহাসে ক্ষণকালের জন্যই। বুদ্বুদের মতো অল্প সময়েই তার বিনাশ ঘটে। এই সত্যটিকেই কবি 'ফেনাইয়া ' শব্দের মাধ্যমে বুঝিয়েছেন।
(৮) "উঠে কত হলাহল , উঠে কত সুধা !"
--কোন প্রসঙ্গে কবি এই মন্তব্যটি করেছেন ? উক্তিটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত 'খেয়া' কবিতায় কবি মানব সভ্যতার অগ্রগতি প্রসঙ্গে উক্ত মন্তব্যটি করেছেন।
মানুষ তার জীবনযাত্রার মানকে ক্রমাগত উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তার এই ক্রমাগত উন্নতির পথে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে। তার এই ক্রমাগত উন্নতির ইতিকথাই হল মানব সভ্যতার ইতিহাস।
মানুষ যত সুখস্বাচ্ছন্দ্য পেয়েছে , ততই তার মধ্যে আরও বেশি পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বা লোভ জেগেছে। সভ্যতার অগ্রগতি মানুষের হাতে ভয়ংকর অস্ত্রের যোগান দিয়েছে। ক্ষমতা দখলের লোভে মানুষ মেতে উঠেছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। এক সাম্রাজ্যের অবসানে সূচনা হয়েছে নতুন সাম্রাজ্যের। রক্তস্রোতের মধ্যে লেখা হয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাস।
পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী সমুদ্র মন্থনে হলাহল এবং সুধা অর্থাৎ বিষ ও অমৃত দুইই উঠেছিল। কবির মতে সভ্যতার অগ্রগতিতেও তেমনি বিষ আর অমৃত দুইই উঠে এসেছে। কবি সভ্যতার ক্ষতিকারক রূপকে বিষ আর কল্যাণময় রূপকে সুধা বলেছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে অনেকক্ষেত্রেই সভ্যতার ক্ষতিকারক রূপ তার কল্যাণময় রূপকে ছাপিয়ে বড়ো হয়ে উঠেছে। নাগরিক জীবনের এই পরিণতি কবিকে কষ্ট দিয়েছে। তাই তিনি পল্লীজীবনের শান্ত - মাটির গন্ধমাখা রূপটির উল্লেখ করেছেন। সেখানে সভ্যতার অগ্রগতি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি বলেই বোধহয় আবহমান কাল ধরে মানুষের সঙ্গে মানুষের মানবিক সম্পর্ক বেঁচে আছে।
No comments:
Post a Comment