বঙ্গভূমির প্রতি
মাইকেল মধুসূদন দত্ত
রেখো, মা , দাসেরে মনে , এ মিনতি করি পদে।
সাধিতে মনের সাধ
ঘটে যদি পরমাদ ,
মধুহীন করো না গো তব মনঃকোকনদে।
প্রবাসে , দৈবের বশে ,
জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে , নাহি খেদ তাহে।
জন্মিলে মরিতে হবে ,
অমর কে কোথা কবে ,
চিরস্থির কবে নীর , হায় রে জীবন-নদে ?
কিন্তু যদি রাখ মনে ,
নাহি , মা, ডরি শমনে ;
মক্ষিকাও গলে না গো পড়িলে অমৃত-হ্রদে।
সেই ধন্য নরকুলে ,
লোকে যারে নাহি ভুলে ,
মনের মন্দিরে সদা সেবে সর্বজন।
কিন্তু কোন গুণ আছে ,
যাচিব যে তব কাছে ,
হেন অমরতা আমি , কহ , গো, শ্যামা জন্মদে !
তবে যদি দয়া কর ,
ভুল দোষ , গুণ ধর ,
অমর করিয়া বর দেহ দাসে , সুবরদে !
ফুটি যেন স্মৃতি-জলে ,
মানসে , মা, যথা ফলে
মধুময় তামরস , কি বসন্ত কি শরদে !
সার -সংক্ষেপ :
কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত 'বঙ্গভূমির প্রতি ' কবিতায় বঙ্গজননীর প্রতি তাঁর বিনীত মিনতি জ্ঞাপন করেছিলেন। তিনি বলেছেন যে বঙ্গজননী যেন কবিকে চিরকাল মানুষের স্মৃতিতে অমলিন রাখেন। উচ্চভিলাষী কবি বিদেশ যাওয়ার আগে মাতৃভূমির কাছে এই প্রার্থনা জানিয়েছেন যে তিনি যেন কবিকে সর্বদা মনে রাখেন। মানুষের দেহ নশ্বর , কিন্তু স্মৃতি অবিনশ্বর। নশ্বর এই দেহের বিনাশ ঘটলেও নিজের কীর্তির মধ্যে দিয়ে মানুষ অন্য মানুষের মনে অমরত্ব পেতে পারে।
কবি নিজেই বললেন যে , জন্মগ্রহণ করলে মৃত্যু অনিবার্য। নদীতে জল যেমন স্থির নয় , চির প্রবাহমান , তেমন মানুষের জীবনও স্থির নয়। মানব জীবনের ধর্ম চিরপ্রবাহমানতা। কিন্তু কবির বিশ্বাস তিনি কর্মের মধ্যে দিয়ে মানুষের মনে স্থান করে নিতে পারবেন। তাই তিনি মৃত্যুকে ভয় পান না। তিনি মানুষের মনের মন্দিরে চির ভাস্বর থাকতে চান। ক্ষুদ্রতম মক্ষিকাও যেমন অমৃত হ্রদে পড়লে মরে না , অমৃতের স্পর্শে সে যেন অমরত্ব লাভ করে, তেমনি বঙ্গ জননীর স্নেহ লাভ করতে পারলেই কবিও ধন্য হবেন।
কবি বঙ্গমাতার স্নেহের উপর একান্ত নির্ভর করে বলেছেন যে , তাঁর এমন কোন গুণ নেই যে , তিনি বঙ্গভূমির কাছে অমরত্ব প্রার্থনা করতে পারেন , তবে বঙ্গজননী যদি কৃপা করে তাঁর দোষ ত্রূটিকেই গুণ বলে ধরেন এবং তাঁকে অমরত্বের বর দান করেন , তবে এই সুবরদায়িনী বঙ্গমাতার কাছে তিনি চিরকৃতজ্ঞ থাকবেন।
কবিতার শেষ স্তবকে কবি এই অমরত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। গৌড়জনের জন্য তিনি এমন কাব্য রচনা করে যেতে চান যা চিরকালের আনন্দ সুধা বর্ষণ করবে। বঙ্গবাসীর হৃদয়মন্দিরে বিরাজ করে তিনি তাঁদের স্মৃতিতে চির অক্ষয় হয়ে বিরাজ করতে চান, যেমন তিব্বতের মানস সরোবরে সব ঋতুতে পদ্মফুল ফুটে থাকে। এইভাবে কবি বঙ্গবাসীর স্মৃতিতে উজ্জ্বল থেকে অমর হয়ে থাকতে চান।
শব্দার্থ :
দাসেরে - সেবক কে
মিনতি -- প্রার্থনা
সাধিতে - সম্পাদন করতে
সাধ- ইচ্ছা
পরমাদ - ভুল
প্রবাসে - বিদেশে
কোকোনদ - লালপদ্ম
দৈবের বশে - নিয়তি বা দৈবশক্তির প্রভাবে
দেহ - আকাশ -- দেহরূপ আকাশ
খেদ - দুঃখ , অনুশোচনা
নরকুলে- মানব সমাজে
নিত্য - সর্বদা
সেবে- সেবা করে
মাগিব - প্রার্থনা করিব
হেন- এইরূপ
শ্যামা - শ্যামলা বঙ্গভূমি
জন্মদে - জন্ম দেন যিনি
মানসে -- মানস সরোবরে
তামরস - পদ্মফুল
প্রশ্ন ও উত্তর
(১) " প্রবাসে , দৈবের বশে ,
জীব-তারা যদি খসে
এ দেহ-আকাশ হতে , নাহি খেদ তাহে। "
(ক) ' প্রবাসে ' বলতে কী বোঝানো হয়েছে ?
(খ) কবি উল্লিখিত উক্তিটির মধ্যে দিয়ে কী বোঝাতে চেয়েছেন ?
(গ) কবির খেদ নেই কেন ?
(ঘ) তিনি কী কামনা করেছেন ?
উত্তর :
(ক) ' প্রবাসে ' শব্দটির অর্থ বিদেশে। কবি মধুসূদন দত্ত ১৮৬২ সালের ৯ই জুন ইউরোপ যাত্রা করেন। তাঁর অন্যতম বন্ধু গৌরদাস বসাককে 'ইউরোপ যাত্রার পূর্বে একটি পত্র লেখেন ৪ ই জুন। সেই পত্রের সঙ্গেই 'বঙ্গভূমির প্রতি ' কবিতাটি তিনি পাঠিয়েছিলেন বন্ধু গৌরদাস বসাককে।
(খ) কবি বলেছেন বিদেশে গিয়ে নিয়তির কবলে পড়ে কোনো দৈবদুর্বিপাকে পড়তে পারেন। এবং তার ফলে আকাশ থেকে যেমন তারা খসে পড়ে সেইরূপ দেহ থেকে জীবন খসে পড়ে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। কবি এখানে জীবনকে তারার সঙ্গে ও দেহকে আকাশের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
(গ) কবি বলেছেন বঙ্গজননী যদি তাঁর মনের মনিকোঠায় কবিকে স্থান দেন তবে প্রবাসে গিয়ে যদি তাঁর মৃত্যুও হয়ে যায় , তবু তিনি কোনো খেদ বা অনুশোচনা করবেন না।
(ঘ) তিনি বঙ্গজননীর কাছে কামনা করেছেন , মা যেন তাঁকে মনে রাখেন। মনের সাধ পূর্ন করতে গিয়ে যদি কোনো প্রমাদ বা ভুল হয়ে যায় তাঁর তবুও মনরূপ পদ্ম থেকে মধুসূদনকে ভিন্ন না করেন।
(২) "জন্মিলে মরিতে হবে ,
অমর কে কোথা কবে ,"
(ক) ' অমরত্ব ' বলতে কী বোঝানো হয়েছে ?
(খ) কবি এই চিরন্তন কথাটি দ্বারা কী বোঝাতে চেয়েছেন ?
(গ) এই প্রসঙ্গে কবি কী তুলনা দিয়েছেন ?
(ঘ) তিনি কী ধরনের অমরত্ব লাভ করতে চেয়েছেন ?
উত্তরঃ
(ক) ' অমরত্ব' বলতে মৃত্যুহীনভাবে চিরকাল বেঁচে থাকাকে বোঝানো হয়েছে।
(খ) কবি বোঝাতে চেয়েছেন মানুষ জন্মলাভ করলে তার মৃত্যু অনিবার্য। জগতের কেউ কোথাও কখনও অমরত্ব লাভ করতে পারেনি।
(গ) এই প্রসঙ্গে কবি বলেছেন , নদীর মধ্যে দিয়ে জলধারা যেমন বহমান , নদীর স্রোতধারা যেমন থেমে থাকে না , তেমনি জীবনও চিরপ্রবহমান। জীবনের গতি কখনও শ্লথ হয় না। নদীর জলধারা যেমন শেষপর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে সাগরে মেসে , জীবনও তেমনি নিঃশেষ হয়ে মৃত্যুর মধ্যে সমাহিত হয়। এই চিরন্তন সত্যটিকে কবি এইভাবে উপমিত করেছেন।
(ঘ) কবি জৈবিক অমরত্ব লাভ করতে চান না। তিনি বঙ্গজননীর কাছে প্রার্থনা করেছেন যাতে তিনি সকল মানুষের মনে নিজ কীর্তির দ্বারা চির অম্লান হয়ে থাকতে পারেন। মানুষের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে চিরকাল বেঁচে থাকার মধ্যে দিয়ে তিনি অমরত্ব পেতে চান।
(৩) "কিন্তু কোন গুণ আছে ,
যাচিব যে তব কাছে ,
হেন অমরতা আমি , কহ , গো, শ্যামা জন্মদে ! "
(ক) ' শ্যামা জন্মদে ' বলতে কার কথা বোঝানো হয়েছে ?
(খ) 'হেন অমরতা ' বলতে কোন শ্রেণির অমরতাকে বোঝানো হয়েছে ?
(গ) কবি কী প্রার্থনা করেছেন ?
(ঘ) কবি পরমুহূর্তেই নিজের জন্য কীভাবে প্রার্থনা পূরণের উপায়ের সন্ধান দিয়েছেন ?
উত্তরঃ
(ক) 'শ্যামা জন্মদে ' বলতে শস্যশালিনী জন্মদাত্রী বঙ্গমাতাকে বোঝানো হয়েছে।
(খ) 'হেন অমরতা ' বলতে মানুষের সেই অমরতাকে বোঝানো হয়েছে যা তাকে মনুষ্যকুলে ধন্য করে। মানুষ যেন কখনও তাঁকে বিস্মৃত না হয়। মানুষের 'মনের মন্দিরে ' তিনি যেন দেবতার আসনে অধিষ্ঠিত থেকে নিত্যদিন 'সেবা' পান। এই অমরতা চির অক্ষয় আয়ু নয় , এই অমরতা চিরঅম্লান কীর্তির দ্বারা অর্জিত হয়।
( গ) কবি প্রার্থনা করেছেন বঙ্গমাতা যেন তাঁর মন থেকে কবিকে সরিয়ে না দেন। তাঁর কৃপা পেলে কবি সকলের মনে চির অক্ষয় হয়ে বিরাজ করবেন। তাঁর হয়তো কোনো গুণই নেই তবু এই অমরতা তিনি প্রার্থনা করেন, যার দ্বারা কাব্যরসিকদের কাছে সাহিত্যিক হিসাবে তিনি অমর হয়ে থাকতে পারেন।
(ঘ) কবি বলেন , তাঁর এমন কোন গুণ নেই যে বঙ্গমাতার কাছে এমন অমরতা তিনি প্রার্থনা করতে পারেন। কিন্তু পরমুহূর্তেই বঙ্গমাতার অপার কৃপা লাভের প্রত্যাশী কবি বলেন , মা যদি তাঁর ভুল ত্রূটি মার্জনা করে শুধু গুণটুকু ধরেন , তবেই এই অমরত্ব আশীর্বাদের দ্বারা সুবরদায়িনী বঙ্গ জননী কবিকে ভরিয়ে তুলতে পারেন। তার কাব্যপ্রতিভাকে গুণ রূপে বিবেচনা করে কবির প্রার্থনা মঞ্জুর করা যায় ----- এই উপায়ের সন্ধান কবি দিয়েছেন।
(৪) " ফুটি যেন স্মৃতি জলে ,
মানসে মা যথা ফলে
মধুময় তামরস কি বসন্তে , কি শরদে !"
(ক) কার স্মৃতিতে ফুটে থাকতে চান কবি ?
(খ) এই ইচ্ছা তিনি কার কাছে কামনা করেছেন ?
(গ) "তামরস " বলতে কী বোঝানো হয়েছে ?
(ঘ) উক্ত অংশের অন্তর্নিহিত অর্থ ব্যাখ্যা কর।
উত্তরঃ
(ক) কবি মধুসূদন তাঁর মহান সাহিত্যকীর্তি দ্বারা মনুষ্যসমাজের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকতে চান চিরকালের জন্য। তাঁর এ কামনা সর্বদেশের সর্বকালের কবি - সাহিত্যিকদেরই কামনা। প্রত্যেক সাহিত্যিকের কামনা , মানুষের স্মৃতিতে সশ্রদ্ধ জাগরিত অস্তিত্ব। যাতে তাঁদের মৃত্যুর পরও আমরা মনে রাখি , তাঁদের কীর্তির জন্য তাঁদের স্মরণ করি --- এই টিই কবির একান্ত ইচ্ছা ; অসংখ্য ভক্তজনের হৃদয়পদ্ম হয়ে ফুটে থাকায় তাঁর একমাত্র অভিপ্রায়।
(খ) এই ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করেছেন সুবরদায়িনী বঙ্গজননীর কাছে। কারণ , তাঁর কৃপা না পেলে কবির এই ইচ্ছা কখনও পূরণ হবে না।
(গ) " তামরস " বলতে পদ্মফুলকে বোঝানো হয়েছে।
(ঘ) কবি মধুসূদনের একান্ত কামনা ছিল , তাঁর নশ্বর দেহটার বিনাশ হলেও তাঁর নাম অমলিন হয়ে থাকুক মানুষের মনের মণিকোঠায়। তিব্বতের মানস সরোবরে যে পদ্মফুল সারা বছর ফুটে থেকে তার সৌন্দর্য বিতরণ করে , কবিও তেমনি সারাজীবন মানুষের স্মৃতিতে চির অক্ষয় হয়ে বিরাজ করতে চান। অমর হয়ে মানুষের মনে থাকতে চান কবি তাঁর কীর্তি ও যশের দ্বারা।
Thank you so much for this wonderful writing
ReplyDelete👎👎👎👎
ReplyDeleteখুব সুন্দর করে ব্যাখ্যা দিওয়েছেন, ধন্যবাদ!
ReplyDeleteখুব সুন্দর
ReplyDeleteKhub sundor kore likhechen. Dhonnyobad
ReplyDelete👌👌👌👌👌👌👌👌😍😍
ReplyDeleteThank you so much
ReplyDelete